বিজ্ঞাপন

অদম্য মিনারের ফিরে আসা

March 30, 2018 | 11:51 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মিনার উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা শেষ, এবার ছবি তোলার পালা। মিনার চায় এক ফ্রেমে আটকা পড়ুক পরিবারের সবাই। তাই মিনার মাকে ডাকলেন, মা ডাকলেন তার মাকে, এরপর এলেন মিনারের চাচা, ভাই আর বোনের স্বামী।

মিনারের একক ছবির ফ্রেমটি হয়ে যায় পারিবারিক একটি ছবি, যে ছবির সবার মুখেই লেগে আছে হাসি।

অথচ এই মিনারের বেঁচে থাকাটা ছিল যেন অলৌকিক কিছু। চিকিৎসকদের দুঃসাধ্য প্রচেষ্টার ফলে মিনার পেয়েছেন নতুন এক জীবন।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল পুরনো কথা, নতুন কথা হলো— মিনার সরকারি চাকরি পেয়েছে। সে এখন দেশের প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা।

গত ১৫ মার্চ ৩৬ তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে নন-ক্যাডার সুপারিশে মিনার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পান।

বিজ্ঞাপন

এ খবর শুনে তাদের পুরান ঢাকার ছয় তলার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাসা আত্মীয়-স্বজনে ভর্তি।

আট মাস ভারতে চিকিৎসা শেষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন মিনার।

মিনার বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর দুই ভাই তাকে কাঁধে নিয়ে ছয়তলা বাসার এদিক-সেদিক নিয়েছেন। মা হাত ধরে পাশে থেকেছেন। বন্ধুরাও ছায়ার মতো থেকেছে পাশে।

বিজ্ঞাপন

কথা বলতে বলতে মিনারের চোখ ভিজে ওঠে। মিনার বলেন, ‘আমার হাত নেই, পা নেই, হেঁটে গেলে মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইন্ডিয়াতেও মানুষ তাকিয়ে থেকেছে, তাদের সেই চোখও আমি দেখেছি’— জানালা দিয়ে বর্গাকার আকাশ দেখেন আর নিজের বিগত দুঃখের কথা বলতে থাকেন মিনার।

২০০৭ সালে বাবা হারান মেধাবী মিনার। তারপর টিউশনি করিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন, চালিয়েছেন পরিবার। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ করে ঈদের ছুটিতে চট্রগ্রামে নিজের বাড়িতে যান। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর একটি ভবনের ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়েন মিনার।

সে রাতেই প্রথমে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভর্তি হন। পরদিন নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সেখানে আইসিইউতে কাটে ২ মাস ২৪ দিন। মোট ১১ বার অস্ত্রোপচার শেষে কাটা পড়ে একটা হাত। মিনারকে বাঁচাতে তখন দরকার হয় ২৫ ব্যাগ রক্ত।

এরপর মিনার যান ভারতে। ভেলরের সিএমসিতে ভর্তি ছিলেন ৪৮ দিন। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে মিনার বলেন, ‘আমার জটিলতাগুলো ছিল অনেক বেশি।’

ঢাকা মেডিকেলে পুরো শরীর থেকে চামড়া নিয়ে এত কিছু করা হলো যাতে আমার পা-টা রক্ষা পায়। আমিও চেয়েছিলাম পা থাকুক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর বাঁচানো গেল না। বারবার ইনফেকশনের কারণে অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছে সাতটা— বলেন মিনার।

মিনার বলেন, ‘বাম পায়ে ৮ অগাস্ট এবং ২৮ সেপ্টেম্বর অস্ত্রোপচার হয়, পরে ডান পায়ে অস্ত্রোপচার হয় ৫ অক্টোবর। সেদিন সকাল ১০টা থেকে অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে রাত তিনটার দিকে ওটি থেকে বের করা হয়। আমার রাতদিন কিছু বোঝার সুযোগ ছিল না, কিছু মনে ছিল না আমার। কিন্তু সেই অস্ত্রোপচারে কিছু ভুল হয়ে যায়, হয়ে যায় ইনফেকশন। এতে করে চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন।’

পরে ১৩ অক্টোবর অস্ত্রোপচার করে ডান পা কেটে ফেলা হয় মিনারের। পায়ের ইনফেকশনের কারণে ২৬ অক্টোবর, ৬ নভেম্বর অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু তাতেও রেহাই হয়নি মিনারের। আবারও ইনফেকশন হানা দেয়, তাতে করে ১৩ ডিসেম্বর আবার অস্ত্রোপচার করতে হয়।

আসল পায়ের বদলে মিনার এখন কৃত্রিম পায়ের মালিক। এখন প্লাস্টিকের পা দিয়ে নিজে দাঁড়াতে পারে, নিজের কাজগুলো নিজেই করতে পারে।

মিনার বলেন, ‘আমি জানতাম, সময়গুলো কেটে যাবে, যত কঠিন সময়ই হোক কেটে যাবে- তাই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম। এখান তো কঠিন সময় পার হয়েছে। এটিই জানতাম, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘১৩ ডিসেম্বরের পর আমাকে পিএমআর (ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) ট্রেনিং করানো হয়েছে। আমাকে শেখানো হয়েছে, কী করে আমি শার্টের বোতাম লাগাব, রাস্তায় হাঁটব, সিড়ি ‍দিয়ে উঠব, কী করে গাড়িতে উঠব, কীভাবে দৌঁড়াব। আমাকে সব শিখিয়েছে ওরা, আমাকে জীবনটা ফেরত দিয়েছে।’

সিএমসিতে প্রথম তিনমাস দুই ভাই ছিল মিনারের সঙ্গে। কিন্তু ৫ অক্টোবরে বড় অপারেশনের আগে চিকিৎসকরা বলেছিলেন মা, স্ত্রী কিংবা বোনকে দরকার হবে। তাই মা গিয়েছিলেন, ছিলেন ৫ মাস। পুরো পরিবারই ছিল আমার সঙ্গে— মিনার বলেন, হাসেন।

মিনার বলেন, ‘ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই সে সব মানুষগুলোকে যারা আমার জন্য এগিয়ে এসেছেন, ফেসবুকে আমাকে নিয়ে লেখা দেখে নানাভাবে নানাজন আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। যাদের আমি সামনাসামনি দেখিনি, তারাও দেখেননি আমাকে। কিন্তু আমার বিপদের দিনে তারা আমার পাশে থেকেছেন- সবাইকে আমি সারাবাংলার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিচ্ছি, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি’—বলে চোখের কোণ মোছেন অদম্য এই মিনার উদ্দিন।

মিনার চুপ থাকেন, চুপ থাকেন ঘরের অন্যরাও।  কিছুক্ষণ নীরবতার বাঁধ ভেঙে মিনার বলেন, ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সেই জার্নি শেষ হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি।

২৮ ফেব্রুয়ারি সিঁড়িতে কাকে যেন ধরে ধরে ছয় তলায় উঠছিলাম আর ভাবছিলাম, আমার চিকিৎসার জার্নিটা শেষ হল, কিন্তু শুরু হলো যুদ্ধটা। আমার চ্যালেঞ্জিং লাইফ, এই পা দিয়েই আমাকে চলতে হবে, এভাবেই আমাকে কাটাতে হবে জীবনের বাকি সময়।

সারাবাংলা/জেএ/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন