বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে সমাহিত হতে লুসি হেলেনের ইচ্ছা ও শেখ রেহানার সেই চিঠি

March 31, 2018 | 5:41 pm

।। মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: জীবন সায়াহ্নে এসে লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট এই বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ারই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মানবতার সেবক এই ব্রিটিশ নারীর সে ইচ্ছা পূরণে সব ব্যবস্থা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা। দুই বোনের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেন লুসি হেলেন। শনিবার (৩১ মার্চ) বিকেলে গণভবনে দুই বোন মিলেই সেই নাগরিকত্বের সনদ লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্টের হাতে তুলে দেন। এখন তার মৃত্যুতে বাংলাদেশেই সমাহিত করতে আর কোনও বাধা থাকবে না। সনদ তুলে দেওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্টকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দিলো। এতে অক্ষুণ্ন থেকে গেলো তার ব্রিটিশ নাগরিকত্বও। গত ২২ মার্চ সরকার এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এবং এক সপ্তাহের মাথায় ৩১ মার্চ লুসি হল্টের হাতে তুলে দেওয়া হলো বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সনদ। এর ফলে তিনি একজন বাংলাদেশের নাগরিকের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এবং একই সাথে ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবেও তার প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্টকে ১৫ বছর মেয়াদি ভিসা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেন।

বিজ্ঞাপন

কে এই লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট?

মানবতার সেবাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে ১৯৬০ সালের ৯ নভেম্বর বাংলাদেশে আসেন লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট। তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। ইংল্যান্ডের কোল হিলসে জুনিয়র স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সে চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন। এখানে তখন সকল ইতিহাসই বঞ্চনা আর অবহেলায় ঘেরা। আর ছিলো রোগ-ব্যাধি, ঝড়-ঝঞ্ঝায় কাবু এক ভূ-খণ্ড। পাকিস্তানি শাসকের শোষণ বঞ্চনা ও নিপীড়নে এক বিপর্যস্ত জাতি। তারই সেবায় ছুটে আসেন লুসি হল্ট। এরপর আসে ১৯৭১। বাঙালি তখন মুক্তির লড়াইয়ে। সে সময়টিতে যশোর ক্যাথলিক চার্চে ছিলেন লুসি। সকলেই যখন খুলনার দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন লুসি হেলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে যশোর ফাতেমা হাসপাতালে থেকে যান। অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সে শুশ্রুষা করেন তিনি। পুরো যুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অসামান্য অবদান রাখেন। আর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি নারী ও শিশুদের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। এ জন্য তিনি যশোর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে কাজ করেন।
২০০৪ সালে লুসি হেলেন বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে দুঃস্থ শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ব্রত নেন। বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে এই মহান কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন সেই থেকে। আর নিজের জীবন ধারণের খরচ চালাতেন ইংল্যান্ড থেকে পাওয়া কিছু পেনশনের টাকায়।

বিজ্ঞাপন

এভাবেই তিনি বাংলাদেশের জন্য দান করেছেন তার জীবনের ৫৭টি বছর। আর এটাও নিশ্চিত করেছেন, আর যে কটা দিন বেঁচে থাকবেন, বাংলাদেশেই থাকবেন। আর তার অন্তিম শয়ানও যেনো বাংলাদেশেই হয়, সে ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি। সে জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চান লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট।

এ সংক্রান্ত একটি চিঠি তিনি গত ২২ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে পাঠিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সে আবেদনে যথাযথ গুরুত্ব দেয় সরকার। সকল স্তর পার করে তা যায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা, স্মরণ করেন লুসি হেলেনের সকল অবদানের কথা। তাদের মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সাথেও ছিলো লুসি হেলেনের দারুণ সখ্য। ১৯৭৩ সালে কিছু উপহারসহ শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন লুসি হেলেন। নিজের ব্যস্ততার কারণে সে চিঠিরও একটি উত্তর তিনি ছোট মেয়ে শেখ রেহানাকে দিয়ে লিখে পাঠিয়েছিলেন। মায়ের হয়ে সে চিঠিতে শেখ রেহানা লিখেছিলেন, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার উপহারের জন্য। মা খুব খুশি হয়েছেন। বেশি খুশি হয়েছেন আপনার বাংলা লেখা পড়ে।’

বাংলাদেশে একজন বাঙালিই হয়ে রয়েছেন এই লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি যাননি। যুদ্ধাহতদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। সে সময় তিনি নিজের বন্ধু ও পরিচিতদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়তে চিঠি লেখেন। বাবা-মায়ের কাছে চিঠি লিখে তিনি জানাতেন বাংলাদেশে পাকিস্তানিতে অত্যাচার- নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের কথা। তার এসব চিঠি বাংলাদেশের যুদ্ধকালের দলিল হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। লুসি হেলেন এ সময় তার সকল চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতেন।

বিজ্ঞাপন

লুসি হেলেন ফ্রান্সেস হল্ট ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন জন হল্ট ও মা ছিলেন ফ্রান্সেস গ্রেস হল্ট। বর্তমানে তিনি বরিশাল শহরে অক্সফোর্ড মিশনে বাস করছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পূরণে আর বাধা থাকবে না।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন