বিজ্ঞাপন

জীবন বাঁচানো মাস্ক যখন জীবনের জন্যই হুমকি

August 27, 2021 | 11:45 am

মো. আরিফুর রহমান আরিফ

অদৃশ্য এক অণুজীব করোনাভাইরাস, যার দাপটে আজ সারা পৃথিবী স্তব্ধ। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র সুরক্ষা সামগ্রী মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভস, পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী। সাধারণ মানুষজন, রোগী ও চিকিৎসকদের জীবন বাঁচানো এইসব সুরক্ষা পণ্যই এখন হয়ে উঠছে জীবন আর পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এই মাস্ক ব্যবহারের পর হাসপাতালের বর্জে্যর মত আগুনে পুড়িয়ে ফেলার কথা; কিন্তু তা না করায় ব্যবহৃত মাস্কই হচ্ছে পরিবেশ দূষনের জন্য নতুন আতঙ্ক। আর প্রকৃতি-পরিবেশ আর মানবজীবন তো স্পষ্টতই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই আজ করোনা ভাইরাস থেকে জীবন বাঁচানো মাস্কই যেন হয়ে উঠছে জীবনের জন্য হুমকি।

বিজ্ঞাপন

এখন চলছে বর্ষাকাল। বৃষ্টিতে আমাদের শহরগুলো মুখোমুখি হচ্ছে জলাবদ্ধতার। রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা টানা কয়েকঘন্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায়। এদিকে আবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বৃষ্টির পানিতে মানুষ ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। শুধু কি বৃষ্টিই দায়ী এই জলাবদ্ধতার জন্য? নাকি শহর থেকে পানি বের হয়ে যাওয়ার পথগুলো ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? শহরের বেশির ভাগ নর্দমার মুখ অবরুদ্ধ করে রেখেছে প্লাস্টিক বা পলিথিন, আর এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক।

করোনা ভাইরাস শুধু মানবজাতি নয়, পরোক্ষভাবে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতি ও অন্যান্য জীব সম্প্রদায়ের ওপর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান একটি উপায় হলো ফেস মাস্কের ব্যবহার। কিন্তু এই উপায় মানবদেহকে কিছুটা সুরক্ষা প্রদান করলেও ব্যবহৃত মাস্কটির সঠিক নিষ্পত্তি না হলে, তা হয়ে উঠবে প্রকৃতি, পরিবেশ তথা মানবজীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।

করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগেও কিছু স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ বায়ুদূষনজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত মাস্ক পরতেন। এখন করোনা ভাইরাস পৃথিবীর সকল হিসেব-নিকেশই পাল্টে দিয়েছে। ফেস মাস্ক কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন সার্জিক্যাল মাস্ক, এন-৯৫ মাস্ক, কাপড়ের তৈরি মাস্ক ইত্যাদি। তবে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে সার্জিক্যাল মাস্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, এন-৯৫ মাস্ক হলো একধরনের বিশেষায়িত মাস্ক, যা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ফিল্টার করতে সক্ষম। এর মধ্যে বেশিরভাগই সিনথেটিক কাপড়ের ও সার্জিক্যাল মাস্ক- যেটা ওয়ান টাইম মাস্ক নামে পরিচিত। বেশিরভাগ মানুষজনই সার্জিক্যাল মাস্ক পড়তে পছন্দ করে। সার্জিক্যাল মাস্ক একটানা ৬ ঘন্টা ব্যবহার উপযোগী, এরপর এই মাস্কের কার্যক্ষমতা থাকে না। এদিকে আবার এই সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের পরই শুরু হয় এর অপব্যবহার। অপব্যবহার এজন্য বলা কারণ ব্যবহারের পর মাস্ক কি করবো, কোথায় ফেলবো- এর ন্যূনতম ধারনা বেশিরভাগ মানুষের নেই। আগে আমরা যেখানে-সেখানে থু-থু ফেলতাম এখন যেখানে সেখানে মাস্ক ফেলি। রাস্তাঘাটে, পরিবহনের ভেতরে, সর্বত্র যেন ব্যবহৃত মাস্কের প্রদর্শনী।

বিজ্ঞাপন

সময়ের প্রয়োজনে বেশিরভাগ মাস্কই ব্যাবহার হয় কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে। আগে শুধু ডাক্তারি পরীক্ষাকেন্দ্র, রাসায়নিক গবেষণাকেন্দ্র এবং কিছু খাদ্যদ্রব্য তৈরির স্থানে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে মাস্ক পরিধান অনেকটা বস্ত্র পরিধানের মতোই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সেই যে ২০১৯ এর ডিসেম্বরে শুরু আর কতদিন যে মাস্ক পরতে হবে তা কেউ বলতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসির মতে, ভ্যাকসিনেটেড মানুষেরও মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে মাস্ক আমাদের জীবনে প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে।

সর্বসাধারণের ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া মাস্ক পরিবেশের ক্ষতি করা ছাড়া ভাইরাস ছড়ানোতেও ভূমিকা রাখছে। অনেকেই যেখানে–সেখানে ফেলে দিয়ে থাকে ব্যবহৃত মাস্ক। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দি কনভারসেশন’ নামক গবেষণা পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, কয়েকটি পরিবেশে এ ভাইরাস প্লাস্টিক পদার্থ দিয়ে তৈরি সার্জিক্যাল মাস্কে সাত দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। বাংলাদেশের মাস্ক ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করছে এসব সার্জিক্যাল মাস্ক। দাম কাপড়ের তৈরি মাস্কের তুলনায় অনেক কম। কাপড়ের তৈরি একটি মাস্ক যেখানে পাওয়া যায় ৩০-১৫০ টাকায়, সেখানে সার্জিক্যাল একটি মাস্কের দাম তিন-পাঁচ টাকা। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক মানুষের কাছে সহজলভ্য এসব সার্জিক্যাল মাস্ক বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু অসচেতনতার কারণে এ মাস্কের মাধ্যমে একদিকে যেমন ছড়াচ্ছে জীবাণু, তেমনি অপর দিকে যেখানে–সেখানে পড়ে থাকা এসব মাস্ক জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখছে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি মাসে প্রায় ১২৯ বিলিয়ন সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক ব্যবহৃত হচ্ছে, যা প্রতি মিনিটে তিন মিলিয়ন। তাদের বেশির ভাগ হলো প্লাস্টিকের মাইক্রোফাইবার থেকে তৈরি, যা ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। পরিত্যক্ত মাস্কগুলো শুরুতেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর না হলেও মাস্কের কিছু উপাদান যেমন পলি-প্রপেলিন বিনষ্ট হয়ে মাটিতে মিশে যেতে অনেক সময় লাগে আর এটাই পরিবেশের জন্য বড় সমস্যা। ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লোভস অনেকদিন মাটি ও পানির নিচে থাকার ফলে একপর্যায়ে মাইক্রো-প্লাস্টিকে পরিণত হয়। আর কয়েক দশক থেকে কয়েক’শ বছর সময় লাগে এগুলো ক্ষুদ্র উপাদানে পরিণত হতে। যা পরিবেশের জন্যে ভয়াবহ হুমকি।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় এসব সার্জিক্যাল মাস্ক বিশেষ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করা হলেও সমুদ্র উপকূলগুলোয় বেড়েছে মাস্কের সংখ্যা, যার বড় একটা অংশ গিয়ে জমা হচ্ছে নদী বা সমুদ্রের তলদেশে। সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য অনেক জলজীবের দৈহিক বৃদ্ধি, এমনকি প্রজননক্ষমতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এসব সার্জিক্যাল মাস্ক। ওসিয়ানসিয়া, ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী অনুমান করা হয়েছিল, ২০২০ সালে সম্ভবত ১.৫৬ বিলিয়ন মাস্ক মহাসাগরে প্রবেশ করেছে, যা সামুদ্রিক জলজীবের জন্য একটি বিশাল হুমকি।

করোনা মহামারির শুরু বছরখানেক বাদে মাস্যাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের কিছু স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর ওপর তাদের ব্যবহৃত মাস্ক নিয়ে ছয় মাসব্যাপী একটি গবেষণা করে। সেই গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা এ সময় প্রত্যেক আলাদা রোগীর জন্য আলাদা আলাদা এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করেন। তাদের ব্যবহৃত মোট মাস্কের সংখ্যা ছিল ৭.৪ বিলিয়ন। এ মাস্ক তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল ৬.৪ বিলিয়ন ডলার এবং এসব ব্যবহৃত মাস্ক ৮৪ মিলিয়ন কিলোগ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে। গবেষণা দলটি আরও প্রমাণ করে যে উক্ত ব্যবহৃত মাস্কগুলো যদি হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বা অতিবেগুনি আলো ব্যবহার করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা যায়, তাহলে সমপরিমাণ মাস্কের জন্য ব্যয় ১.৪ থেকে ১.৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। শুধু তা–ই নয়, মাস্ক থেকে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ কমে হবে ১৩ মিলিয়ন থেকে ১৮ মিলিয়ন কেজি। গবেষকেরা দাবি করেন, মাস্কের উৎপাদন খরচ ৮৩১ মিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনা সম্ভব যদি এন-৯৫ মাস্কগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব হয়। এর ফলে পরবর্তীকালে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণও ১.৬ মিলিয়ন কেজি কমে আসবে।

এই পরিবেশ দূষণ করার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সাধারণ চিন্তার পরিধি বাড়াতে হবে। অনুধাবন করতে হবে, কোথায় মাস্ক ও ময়লা ফেলা যাবে আর কোথায় ফেলা যাবে না? চিন্তা ও সাধারণ জ্ঞানটুকুর পরিধি বাড়াতে পারলে অনেক কিছুরই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব। কতকাল আমাদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, তা জানা না থাকলেও এটা যে দীর্ঘকাল, সে ব্যাপারে সংশয় নেই বলা যায়। হয়তো নিজেদের জীবনের একটা দিক দেখতে গিয়ে, অন্য অনেক দিকের কথা ভুলে যাচ্ছি আমরা। তবে খুব সহজে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এমন ধরনের মাস্ক ব্যবহারের প্রচলন করতে হবে, যা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হবে অথবা এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি করতে হবে, যা খুব সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারে। এ ছাড়া সার্জিক্যাল মাস্কের উৎপাদন কমিয়ে কাপড়ের তৈরি মাস্কের উৎপাদন বাড়িয়ে ও দাম কমিয়ে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যে প্রচারণা চালানো হয়, তার সঙ্গে ব্যবহৃত মাস্ক কীভাবে ফেলতে হবে, সে ব্যাপারেও একই প্রচারণা চালাতে হবে।

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ঢাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ বায়ুদূষিত শহরের একটি। ঢাকায় প্রতিদিন কেবল গাছপালাতেই ৪৩৬ মেট্রিকটন ধুলিকণা জমে। অতএব জঘন্যতম বায়ুদূষিত শহরে বাঁচতে চাইলে মাস্ক পরিধান চর্চা আজীবন অব্যাহত রাখুন। মাস্ক পরুন, নিরাপদ থাকুন। সঙ্গে ব্যবহার শেষে মাস্কটি সঠিক জায়গায় ফেলুন। আর পরিবেশ দূষণের কারণ হবেন না।

বিজ্ঞাপন

লেখক: পরিবেশ বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন