বিজ্ঞাপন

ধানের নতুন জাত ‘জনপ্রিয়তা’ পেতে সময় লাগে ১৬ বছর!

April 3, 2018 | 8:57 am

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ধানের নতুন কোনো জাত কৃষক পর্যায়ে ‘জনপ্রিয়তা’ পেতে সময় লাগে অন্তত ১৬ বছর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) পরিচালিত ‘রাইস ভিশন ২০৫০’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোন একটি জাত পরিচিতি পেতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগে। সময়টি কমিয়ে ৭ থেকে ৮ বছরের মধ্যে নিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। আর জাত উদ্ভাবিত হলেই তা সাথে সাথে পরিচিতি পাবে, তা নয়। এটি অনেকটা দীর্ঘ প্রক্রিয়াও।’

তিনি আরো বলেন, ‘নতুন জাতের প্রদশর্নীর জন্য আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে যে বরাদ্দ দিয়েছি, মাঠ পর্যায়ে তার কি প্রভাব পড়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে তা পর্যালোচনা করা হবে।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ধানের ভবিষ্যত চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে এবং প্রতিবন্ধকতা দুর করতে ‘রাইস ভিশন ২০৫০’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর।

ড. মো. শাহজাহান কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘উদ্ভাবিত নতুন কোনো জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পেতে ১৬ বছর সময় লাগে। উদ্ভাবনের তুলনায় আমাদের জাতগুলো কিন্তু মাঠে যাচ্ছে না। বিএডিসিকে (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) বলেছি, আমরা জাত উৎপাদন করছি কৃষক কিন্তু তা জানে না। মাঠে জাত পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না। এতে আমাদের সময়ের ক্ষতি হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা জাত উৎপাদন করে তা বিএডিসিকে দিচ্ছি। তারা ফাউন্ডেশন সিড ও সার্টিফায়েড সিড উৎপাদন করবে। আর বিএডিসি বীজ উৎপাদনের পর তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে দিবে। অধিদফতরের কর্মকর্তারা তা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিবে। এটা অনেকটা ত্রিভুজের মতো। তবে উদ্ভাবিত জাতগুলো যাতে আরও দ্রুত পরিচিত করে তোলা যায় সেলক্ষ্যে তিন বিভাগের মধ্যে প্রতিনিয়তই সভা হচ্ছে।’

বিএডিসি চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘উদ্ভাবতি জাতগুলো একেকটি একেক অঞ্চলের। কোনটি হাওড়ের জন্য, কোনটি দক্ষিণাঞ্চলের জন্য। এতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য যে জাতটি ছাড় করা হয় সে অঞ্চলের কৃষকই ওই জাতটি পায়। এতে সারাদেশের কৃষক পর্যায়ে পরে ওই জাতটি জনপ্রিয় হতে বেশ সময় লাগে।’

তিনি বলেন, ‘বিএডিসি এটা ততক্ষণ পর্যন্ত বাজারজাত করে না যতক্ষণ পর্যন্ত ওই বীজের বাজার তৈরি না হয়। মাঠ পর্যায়ে বীজটিকে জনপ্রিয় করতে প্রচুর পরিমাণে প্রদর্শনী হয় না, এটাই আমার মতে মূল প্রতিবন্ধকতা।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বর্তমানে নতুন জাতের প্রদর্শনীর সংখ্যা বেড়েছে। গত দুই বছর ধরে জাতগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলতে রাজস্ব বাজেট হিসেবে থোক বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আওতায় ফসল প্রদর্শনী ও প্রযুক্তি প্রদর্শনীর জন্য ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। চলতি অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৫৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এই বাজেটের আওতায় ধানসহ আরও কিছু ফসল ও প্রযুক্তির প্রদর্শনী করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, বরাদ্দের আওতায় শুধু ধানের জাত পরিচিতিকরণই প্রধান্য পাওয়ার কথা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আওতায় ফসল প্রদর্শনীর মধ্যে চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি ধান-৫০, ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-৫৮, ব্রিধান-৫৫, ব্রিধান-৬১, বিনা ধান-১৪ ও বিনা ধান-১০ এর প্রদর্শনী চলছে। সারাদেশে এমন প্রদর্শনীর সংখ্যা ১০ হাজার। অপরদিকে, ব্রি উদ্ভাবিত সর্বশেষ বোরোর জাত হচ্ছে ‘ব্রি ধান-৮৬’। মাঠে চলমান প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত বোরোর সর্বশেষ জাত ব্রি ধান-৬১, যা জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে ছাড়া পেয়েছে ২০১৩ সালে! অপরদিকে আসছে আউশ মৌসুমে প্রদর্শনীর জন্য মাঠ পর্যায়ের কৃষকের হাতে বিআর-২৬ ও ব্রি ধান-৪৮’র বীজ চলে গেছে। ব্রি উদ্ভাবিত আউশের সর্বশেষ জাত ‘ব্রি ধান-৮৫’ হলেও মাঠে এখন প্রদর্শনী হচ্ছে ব্রি ধান ৪৮’র। আর এই জাতটি বীজ বোর্ড থেকে অনুমোদন পেয়েছিল সেই ২০০৮ সালে।

এখনও কেন পুরোনো জাতের প্রদর্শনী এমন প্রশ্নের উত্তরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইয়ের উপ-পরিচালক (সম্প্রসারণ) মো: আব্দুল মজিদ বলেন, ‘নতুন জাত যখন মাঠে যায় তখন কৃষক সহজে তা গ্রহণ করতে চায় না। এছাড়া প্রদর্শনীর জন্য এমন কৃষককে নির্ধারণ করতে হয়, যারা কৃষক হিসেবে বড় ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল।’

তার মতে, জাতগুলো মাঠে যাওয়ার পর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই পরিচিতি পায়।

এক প্রশ্নের জবাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের পারফরমেন্স (কর্মসক্ষমতা) ভালো। তাই সরকার আবারও বরাদ্দ বাড়িয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে প্রদর্শনীর দেখভাল চলছে। বর্তমানে আগের চেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।’

তবে জাতগুলো সহজে মাঠ পর্যায়ে কেন পরিচিত হচ্ছে না এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন।

কৃষি বিজ্ঞানী ও ব্রি’র সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘উদ্ভাবিত কোন জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পেতে ১৬ বছর সময় লাগার কথা না। একটি জাত কৃষকের মাঠে যেতে সর্বোচ্চ ৫ বছর সময় লাগতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যেই উদ্ভাবিত জাত জনপ্রিয়তা পায়।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘উদ্ভাবিত সব জাতকেই ব্রি নতুন ধান হিসেবে দাবি করে। কৃষক যতোক্ষণ কোন জাতকে গ্রহণ করছে না, ততক্ষণ আমরা এটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘যে প্রযুক্তি যতো বেশি শক্তিশালী তা মাঠে জনপ্রিয়তা পেতে ততো কম সময় লাগে। শক্তিশালী কোন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পেতে ৩ বছরের বেশি সময় লাগে না। বিআর-১০ ও বিআর-১১ একই সময়ে উদ্ভাবিত হলেও মাত্র তিন বছরের মাথায় বিআর-১১’র চাহিদা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়েছিল। তিন বছরেরই বীজটির চাহিদা বেড়েছিল তিন গুণ। অর্থাৎ প্রযুক্তির যদি উপযোগিতা থাকে তবে তা জনপ্রিয়তা পেতে বেশি সময় লাগে না।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/জেআইএল/আইএ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন