বিজ্ঞাপন

টাকা ফেরত চাওয়ায় সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খুন: র‌্যাব

November 15, 2021 | 8:40 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: আনোয়ার শহীদ (৭২)। বিয়ের পর স্ত্রী ছেড়ে চলে যাওয়ায় আর বিয়ে করেননি তিনি। কোনো সন্তানও নেই তার। চাকরি থেকে অবসর শেষে ঢাকায় বোনের বাসায় জীবনের সময়টা পার করছিলেন তিনি। অবসরের টাকা দিয়ে তিনি দিনাজপুরে জাকির হোসেন নামে এক লোকের মাধ্যমে একটি জমি কিনে গুদাম ঘর করে ভাড়া দেন। জাকির হোসেন বিশ্বস্ত হওয়ায় তাকে ১২ লাখ টাকা ধার দেন। প্রয়োজনে নিজের টাকা ফেরত চান জাকিরের কাছ থেকে। টাকা দেওয়া দূরের কথা উল্টো ভাড়াটে খুনি দিয়ে সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদকে হত্যা করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর শ্যামলীতে জনবহুল সড়ক হলি লেন গলিতে গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় বাংলাদেশ গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদকে। এ ঘটনায় ছুরিকাঘাতকারী মো. সাইফুল ইসলাম ও মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

সোমবার (১৫ নভেম্বর) কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য তুলে ধরেন।

র‌্যাবের পরিচালক বলেন, সিসিটিভি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আনোয়ার শহীদকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় খুনি। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ছোট বোন ফেরদৌস সুলতানা (৫৯) রাজধানীর আদাবর থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন।

বিজ্ঞাপন

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেন (৩৭) ও হত্যাকারী মো. সাইফুল (২৬) দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে।

স্থানীয় তদন্ত এবং এজাহার সূত্রে জানা যায়, ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যক্তি আনোয়ার শহীদ (৭২) একজন অবসরপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি গম গবেষণা কেন্দ্রে ১৯৭৬ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৮ সালে পরিচালক পদ মর্যাদায় প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মস্থল জয়দেবপুর থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষতা সম্পন্ন কর্মকর্তা ছিলেন। চাকুরি জীবনের সবটুকু সময় তিনি গবেষণার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কর্মস্থলে এবং সামাজিকভাবে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিহত আনোয়ার শহীদ ১৯৮৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও মাসখানিক পরেই তার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি এবং তার কোনো সন্তান নেই। অবসর গ্রহণের পূর্বে এবং পরে ভুক্তভোগী গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার ডোমারে বিভিন্ন সময় দরিদ্র এবং অসহায় আত্মীয় স্বজনকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন বলে জানা যায়। অবসরের পর হতে তিনি তার ছোট বোন এবং মামলার বাদী ফেরদৌস সুলতানার সঙ্গে তার কল্যাণপুরে বাসায় বসবাস করতেন। অবসর গ্রহণের পরে পেনশনের টাকা হতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি দিনাজপুর জেলায় একটি জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করেন এবং তা ভাড়া দেন। তিনি চাকুরিকাল ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় কর্মরত ছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেনের পরিচয় হয়।

গত ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার নিহত আনোয়ার শহীদ তার পূর্ব পরিচিত একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে শ্যামলীতে একটি বাস কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে বাসায় সময় শ্যামলীর হলি লেন গলিতে আসলে তিনি দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সোয়া ৭টা গলিতে মুখে মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ পরে একজন লোক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। আনোয়ার শহীদ প্রধান সড়ক হতে গলিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুর্বৃত্ত তার দিকে এগিয়ে যায় এবং পকেট থেকে ছুরি বের করে পেটে ছুরিকাঘাত করে সরে যায়।

বিজ্ঞাপন

হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার আসামি জাকির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, নিহত আনোয়ার শহীদ দিনাজপুর শহরে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠ হন। দিনাজপুরে তিনি জমি ক্রয়ের সময় জাকির দালাল হিসেবে মধ্যস্থতা করে। এছাড়াও নিহত আনোয়ার শহীদের নিকট হতে বিভিন্ন সময়ে জাকির ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে নেয়। পরে ভুক্তভোগী অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো। গত ১ বছর পূর্বে জাকির তার চালের গোডাউন বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা লোন পাইয়ে দিতে ভুক্তভোগীর সহযোগিতা চান। ভুক্তভোগী তাকে সহযোগিতা করতে অপারগতা জানায়। পরে গত ১ বছর ধরে তার পাওনা ১২ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জাকিরকে চাপ দেন আনোয়ার শহীদ। ওই টাকা লেনদেন সম্পর্কে নিহত আনোয়ার শহীদ ও জাকির ছাড়া কেউ জানতো না। এ প্রেক্ষিতে জাকির গত ৬ থেকে ৭ মাস ধরে আনোয়ার শহীদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তাতে তার ধার করা টাকা দেওয়া লাগবে না। জাকির হত্যাকাণ্ডের ৩ থেকে ৪ মাস পূর্বে ১ বার আনোয়ার শহীদকে তার পূর্ব পরিচিত ধান ও চালের চাতাল শ্রমিক মো. সাইফুলকে দিয়ে পরিকল্পনা করে ঢাকায় হত্যার চেষ্টা করে।

গ্রেফতার সাইফুল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তিনি (মো. সাইফুল) একসময় জাকিরের চালের গোডাউন কাজ করতেন। তিনি একজন নিয়মিত মাদকসেবী এবং মাদক ক্রয়ের জন্য তার প্রায়শই টাকার প্রয়োজন হতো। জাকিরের গোডাউনে কর্মরত থাকাকালে বিভিন্ন সময়ে জাকির সাইফুলকে অর্থ সহায়তা করতেন। গত ৩ থেকে ৪ মাস পূর্বে জাকির সাইফুলকে ঢাকায় আসতে বললে সাইফুল ঢাকায় আসে। এ সময় জাকির সাইফুলকে বলেন, একজন লোক আর্থিকভাবে তাকে অনেক বড় ধরনের ক্ষতি করেছে এবং তাকে হত্যা করতে হবে। সাইফুল যদি ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে জাকির সাইফুলকে জায়গাসহ বাড়ি, অর্থ সহায়তা প্রদান করবে এবং পূর্বের প্রদানকৃত টাকা পরিশোধ করতে হবে না। ওই সময় আনোয়ার শহীদকে হত্যা করার জন্য সাইফুলকে একটি ছুরিও কিনে দেয় জাকির। সাইফুল ইতিপূর্বেও জাকিরের প্ররোচনায় আনোয়ার শহীদ’কে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং পুলিশের উপস্থিতির কারণে তারা ব্যর্থ হয়।

গ্রেফতারকৃত সাইফুল এবং জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সাবেক বৈজ্ঞানিক আনোয়ার শহীদকে হত্যার এই ধারাবাহিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১১ই নভেম্বর সকালে জাকির ও সাইফুল দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে কল্যাণপুরে একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে। হোটেলের কক্ষে বসে জাকির এবং সাইফুল হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাকির হোটেলের পাশের গলির দোকান থেকে ১৮০ টাকা দিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি ক্রয় করে। ওই দিন সন্ধ্যায় পূর্ব নির্ধারিত সময় এবং স্থানে ভুক্তভোগী জাকিরের সঙ্গে দেখা করতে আসলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার কথা বলে ভুক্তভোগীকে স্থানীয় একটি মার্কেটে নিয়ে যায়। পরে কেনাকাটা শেষে করে শ্যামলীর হলি লেন গলিতে আনোয়ারকে নিয়ে আসেন জাকির এবং সাইফুলকে ইশারা দেন। গলিতে আগে থেকে লুকিয়ে থাকা সাইফুল এ সময় আনোয়ারের নিকট এগিয়ে যায় এবং ছুরিকাঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যায়। এ সময় আনোয়ারের পাশেই অবস্থান করছিলেন জাকির।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আনোয়ারের হাত ধরে মাটিতে শুইয়ে দিতে দেখা যায়। আহত আনোয়ার মাটিতে শুয়ে পড়লে পথচারীরা চারপাশে ঘিরে ধরে এবং এই সুযোগে জাকিরকে ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/ইউজে/এনএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন