বিজ্ঞাপন

‘অচেনা’ ছত্রাকে বিবর্ণ গোলাপ গ্রাম, ৩২ কোটি টাকার ক্ষতি

February 8, 2022 | 1:22 pm

শামিম হোসেন শিশির, নিউজরুম এডিটর

ঢাকা: মাঘের শেষ সপ্তাহ, দুয়ারে বসন্ত। এমন দিনে বাহারি রঙের সব গোলাপের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠার কথা রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত গোলাপ গ্রামের। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের কলরবে রীতিমতো খাওয়া-ঘুম মাথায় ওঠার কথা গোলাপ চাষি আর ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সাভারের বিরুলিয়ার সেই গোলাপ গ্রামের চাষিদের মুখ ভার, চোখে জল। বিস্তীর্ণ এলাকার বাগানজুড়ে গোলাপের গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নেই তাতে ফুল। যে গোলাপ বাগান ছিল কৃষকের আগামী বছরের সংসার চালানোর উপার্জনের হাতিয়ার, সে বাগান বিবর্ণ। সেদিকে চাষিরা তাকাতে পর্যন্ত পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় গোলাপ চাষিরা বলছেন, অচেনা এক ছত্রাক হানা দিয়েছে বিরুলিয়া এলাকার গোলাপের রাজ্যে। সেই ছত্রাকের হানায় ফুল ফোটার আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কলি। গোলাপ গাছের নতুন ডগা, এমনকি পুরো গাছও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ছত্রাকের কবলে পড়ে। আর সে কারণেই গোলাপ চাষিদের মাথায় হাত। তারা বলছেন, এই ছত্রাকের কারণে প্রায় ৩২ কোটি টাকার মতো লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।

বিরুলিয়ার শ্যামপুরে কথা হলো গোলাপ চাষি আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই সময়ে আমার বাগানে কয়েক হাজার করে ফুল ওঠার কথা। কিন্তু দেখেন, ছত্রাকের কারণে আজ ফুল উঠেছে মাত্র ১৫০টি। ঋণ করে গোলাপ চাষে নেমেছি, ভাই। ২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি দিতে হয়। এখন কোথায় পাব এত টাকা? বউ-বাচ্চা নিয়ে এখন পথে বসতে হবে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল গোলাপ বাগানের দিকে। তবে তাকিয়ে থাকতে পারছিলেন না। পারবেনই বা কীভাবে, যে বাগান এখন গোলাপের রঙে রঙিন থাকার কথা, ছত্রাকের আক্রমণে যে তা বিবর্ণ। আবুল হোসেনের মতোই একই দশা সাভারের এমন শত শত গোলাপ চাষির। তারা সবাই বলছেন, তাদের এখন পথে বসার দশা।

সাভার উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা গেল, শ্যামপুর, মৈস্তাপাড়া, সাদুল্লাপুর, বাগনীবাড়ি, ভবানীপুর ও বিরুলিয়াসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে এ বছর প্রায় ২৭৫ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় এ বছর আবাদের পরিমাণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষ বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষে যুক্ত হয়ে পড়েছেন ‘গোলাপরাজ্য’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা অঞ্চলটিতে।

বিজ্ঞাপন

গোলাপ গ্রাম ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গোলাপের মৌসুমে শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য কাজে নিযুক্তদের মিলিয়ে ওই অঞ্চলে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকরা আসেন কাজ করতে। গোলাপের মৌসুমে গত কয়েক বছর ধরে দর্শনার্থীরাও দলবেঁধে ছুটে যান ওই অঞ্চলে। গোলাপের সুগদ্ধ আর চোখ জুড়ানো দৃশ্য নিয়ে সেজে থাকা গোলাপগ্রামগুলো দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় এক স্থান হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। কিন্তু এবার না আছে আগের মতো গোলাপের সুগন্ধ, না আছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেল, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে গোলাপের আবাদ হয়েছে আগের চেয়ে বেশি জমিতে। ফলে এ বছরই ছত্রাক হানা দেওয়ায় ক্ষতির পরিমাণও বেশি। কৃষিবিদ মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে জানালেন, এখন পর্যন্ত এ বছর ছত্রাকের কারণে গোলাপ চাষিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২ কোটি টাকা।

২০১০ সালে ফুল চাষিদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘সাভার কুমার খোদা ফুল চাষি বহুমুখী সমবায় সমিতি’র সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান আক্ষেপ নিয়ে সারাবাংলাকে বলছিলেন, ‘আমাদের এই গোলাপগ্রামের বাসিন্দারা সবাই ফুল চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পুরো বিশ্বকে যেমন তছনছ করে দিচ্ছে মহামারি করোনা, তেমনি আমাদের সাভারের গোলাপ চাষিদের ফকির বানিয়ে দিচ্ছে নতুন এই ছত্রাক। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই সময়টাই আমাদের ভরা মৌসুম।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে ফুলের দামও ভালো পাওয়া যায়। ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে আমাদের চাষিদের জন্য প্রধান টার্গেট। কিন্তু এবার সবার মাথায় হাত। অনেকে এমনও আছে যে তার বাগানে ফুল ওঠার কথা হাজারের বেশি, কিন্তু উঠছে এক থেকে দেড়শ। আমাদের কোটি কোটি টাকা লোকশান।’

এই ছত্রাক দেখা দিয়েছিল ২০১৭ সালেও। সেবারও বহু ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল চাষিদের। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষেধক বের হয়নি। এতদিনে প্রতিষেধক বের করা সম্ভব হলে কৃষকদের এত ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না বলে মনে করছেন শাহজাহান।

তিনি বলেন, ‘তখন (২০১৭ সালে) কৃষি অফিসাররা বহুবার এসেছে। তারা ফুল, গাছ, মাটি নিয়ে গেছে পরীক্ষার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার বের করতে পারেনি। এটার যদি প্রতিবার বের করা যেত, তাহলে আমাদের কৃষকদের আজ পথে বসতে হতো না।’

কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ নিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে মোহাম্মদ শাহাজানসহ স্থানীয় কৃষকদের। শাহাজাহান বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তারা আসেন, কীটনাশকের নাম বলে যান। সেগুলো স্প্রে করি, কিন্তু কাজ হয় না। দেখা গেল, একজন এসে আজ এক কীটনাশকের নাম বলছেন, কাল আরেকজন এসে আরেক কীটনাশকের নাম বলছেন। তারা বলে, আমরা ভুল কীটনাশক স্প্রে করেছি। কিন্তু সেটি সত্য নয়। তারা (কৃষিবিদ) যা বলেন, সেটাই আমরা স্প্রে করি।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে গোলাপ চাষি মতিন মিয়া বলেন, ‘তাদের (কৃষিবিদ) তো বিভিন্ন বিষ কোম্পানির (কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানি) সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। তারা কমিশন পায়। সে কারণেই হয়তো একেকজন একেকটি কীটনাশকের নাম বলে। যে যেটার কমিশন পায়, সেটার নামই বলে যায়! অনেকে সেই ভয়ে তাদের বলে যাওয়া কীটনাশক জমিতে ছিটায়ও না।’

গোলাপগ্রামের এমন পরিস্থিতির জন্য বৈরী আবহাওয়া ও কৃষকদের অসতর্কতাকে দায়ী করছেন কৃষিবিদ মো. মোজাম্মেল হক। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ছত্রাকের ওপর কীটনাশক খুব একটা কাজ করছে না। আবার চলমান আবহাওয়াও সমস্যা করছে। এখন শীতের সময়। কিন্তু এই গরম পড়ছে, আবার বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম আবহাওয়াতে ছত্রাক নিয়ন্ত্রণ হয় না। ডিসেম্বরে একটা বৃষ্টি গেল, সেটিও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কৃষকদের দায় তুলে ধরে এই কৃষিবিদ বলেন, ‘কিছু কিছু কৃষক আমাদের কথা শোনে, আবার অনেকে শোনেও না। যেমন আমরা বলি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে। ফুল গাছের দুই সারির মাঝখানে একটি ছোট নালা রাখতে বলি, যেন পানি দ্রুত নিষ্কাশন হয়। কিন্তু অনেকে সেটা করে না। এই ছত্রাক হলে জমিতে একেবারেই পানি দেওয়া যাবে না। কিন্তু গাছ মরে যাচ্ছে দেখে অনেকে আবার জমিতে পানি দিয়ে দিচ্ছে। এতে ছত্রাক আরও ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা পরিদর্শন করছি, চেষ্টা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে।’

এরকম ক্ষতির মুখে পড়ে সরকার থেকে প্রণোদনা তথা সহজ শর্তে ঋণের বন্দবস্ত করার অনুরোধ জানালেন ফুল চাষিদের সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান। জানালেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু ঋণটা পাচ্ছেন না।

শাহজাহান বলেন, ‘এমন দুরবস্থার সময়ে আমরা কিছুই পাচ্ছি না। কৃষি কর্মকর্তারা আসছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন। ব্যাংক ঋণের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু কিছুই পাইনি আমরা। সরকারের পক্ষ থেকে ৪ শতাংশ সুদে যে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো, আমরা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে বহু ঘুরাঘুরির পরও কেউই সেই ঋণ পেলাম না।’

অন্তত এবারে ভরা মৌসুমেও ছত্রাকে আক্রমণে পথে বসে যাওয়া চাষিদের জন্য যেন প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়— এটুকুই প্রত্যাশা গোলাপ চাষিদের।

সারাবাংলা/এসএইচএস/টিআর

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন