বিজ্ঞাপন

রক্তে রাঙা ফাগুনে একুশ অহংকার

February 21, 2022 | 12:07 am

সারাবাংলা ডেস্ক

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়…’

বিজ্ঞাপন

হ্যাঁ, বাঙালির মুখের ভাষা, কেড়ে নিতে চেয়েছিল শোষকেরা। মায়ের মুখ থেকে শেখা যে বুলি, সেই বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল শাসকেরা। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা শাসক-শোষকের সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর সেজন্য তাদের পড়তে হয় অস্ত্রের মুখে। সেখানেও বাঙালি নির্ভীক। তাদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। এসেছিল ভাষার অধিকার— মায়ের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, রাষ্ট্রভাষার অধিকার।

বায়ান্নর সেই ৮ ফাল্গুন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। ৭০ বছর আগের এই দিনেই সালাম, রফিক, বরকতেরা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন ভাষার দাবিতে। তাদের সেই আত্মত্যাগেই বাঙালি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল মুখের ভাষায় কথা বলার দাবি। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি গোটা জাতির কাছে শোক আর গৌরবের দিন। শুধু বাঙালি নয়, ভাষার অধিকার আদায়ের অনন্য এই ইতিহাসকে স্বীকার করে নিয়ে গোটা বিশ্বই দিনটিকে পালন করে থাকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

এই ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরেই জাতি পেয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…’ এই কালজয়ী গান। এদিন তাই শহিদ মিনার থেকে শুরু করে গোটা দেশ বেজে ওঠে এই এক সুরে।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির ভাষার এই লড়াই কেবল ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বলা যায় বাঙালি যে জাতিসত্তা, তারই বিকাশের সূচনা এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। ক্রমেই এই লড়াইয়ের চেতনাই রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই দানা বাঁধার পথ করে দেয়। এই লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতায় একে একে আরও নানা ধাপ পেরিয়ে একাত্তরে চূড়ান্ত সশস্ত্র সংগ্রাম আর রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি অর্জন করে স্বাধীনতার সুবর্ণ সূর্য।

যেভাবে এলো বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি

বুকের তাজা রক্তের বিনিয়ে একুশের যে অর্জন, সেটিও একদিনের লড়াই নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অংশ হয়ে পড়ে এই ভূখণ্ড। নতুন রাষ্ট্র পেলে কী হবে, শিগগিরই এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা বুঝতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তান নামে আরেকটি যে অংশ, তার শোষণ আর নিপীড়নই কেবল তাদের কপালে জুটেছে। ওই সময় থেকেই ডাকটিকিট, মুদ্রা, পোস্টকার্ডে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বেছে নেওয়া উর্দুর একাধিপত্য।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিতে নতুন রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। ছাত্র থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, শিক্ষকসহ সুশীল সমাজও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেন। গঠিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি সংগঠনও। তখনই গঠিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’ সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষার জন্য লড়াইয়ের এসব সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে জাতির জনক কারাবরণ করলেও কারাগার থেকেই রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন বেগবান করতে ভূমিকা রাখতে থাকেন তিনি।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও ব্যবহারের প্রস্তাব দেন কংগ্রেসের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রায় সাত কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটিরও বেশি মানুষের ভাষা বাংলা হলেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই প্রস্তাব গণপরিষদে টেকেনি।

এর প্রতিবাদে শুরু হয় নানা কর্মসূচি। ঢাকায় ক্লাস বর্জন করে ছাত্ররা। বিক্ষোভ হয় বিভিন্ন সরকারি বাসভবনে। পালিত হয় ধর্মঘট। ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় পালিত হয় ‘ভাষা দিবস’।

এরপর এলো ২১ মার্চ। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একমাত্র উর্দু। ইংরেজিতে দেওয়া সেই ঘোষণার সময় হয়তো তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি, পূর্ব পাকিস্তানে দামামা বেজে উঠবে। কয়েকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে একটি বক্তব্যে ফের একই কথা বলেন জিন্নাহ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র ‘না, না’ বলে প্রতিবাদ করেন।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন আসতেই বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য অনেক বেশি বেড়ে যাবে। চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বাঙালিরা উর্দু ভাষার জন্য আরও পিছিয়ে যাবে। ব্যাহত হবে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ও বিকাশ।

এছাড়াও অর্থনীতি, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া বাঙালি জিন্নাহ’র বক্তব্যের পর প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। শোষিত বাঙালির মনে দানা বাঁধা ক্ষোভ ক্রমেই আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে।

ঢাকা থেকে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে থাকে সারাদেশে। তবে বিক্ষোভ, স্মারকলিপি বিতর্ক— এমন নানা কর্মকাণ্ডে খুব বেশি কাজ হচ্ছিল না। ১৯৫২ সালের শুরু থেকে আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর ফলে বেশ জোরেসোরে শুরু হয়ে যায় ধর্মঘট-হরতাল, বিক্ষোভ।

ফাগুনের আগুন ঝরা বায়ান্নর একুশ

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে তখন উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশ। বিশেষ করে ঢাকার আকাশে বাতাসে তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। ছাত্রদের অনমনীয় ভাব আর তুমুল আন্দোলনের প্রস্তুতি দেখে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে প্রশাসন। তবে সরকার তখনো বুঝতে পারেনি, বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাঙালিকে কোনভাবেই দমানো যাবে না।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে বৈঠক হয়, তাতে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত হয়। কীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন বেগবান হবে, তারও পরিকল্পনা হয় সেখানে।

সে অনুযায়ী সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ১৪৪ ধারার বিপক্ষে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকার পলাশীর আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যালে কলেজের সামনে) এলে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। ছাত্রছাত্রীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকলে তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ। একপর্যায়ে গুলি চালালে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। অনেককে আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

রফিক, সালমদের নিহত হওয়ার খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। বাধ্য হয়ে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে সেটি পাসও হয়। তবু বাংলার রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পাস হয় সংবিধান। আর সেই সঙ্গে বাঙালি পায় মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।

ভাষার জন্য কোন জাতির এত বড় আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের সব দেশই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন