বিজ্ঞাপন

রাজনীতিবিদদের দুদক আতঙ্ক

April 13, 2018 | 8:18 am

।। মীর মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আতঙ্কে ভুগছেন দেশের রাজনীতিবিদরা। এরই মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাদের দুদকে তলব করা শুরু হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুদকের এই তৎপরতার কারণে বিচলিত হয়ে পড়ছেন এই দলের রাজনীতিবিদরা। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় থেকে দুর্নীতি বিরোধী তৎপরতা আরও জোরদার করারও দাবি উঠেছে। এদিকে, দুদকও এরইমধ্যে সরকারি দলসহ অন্যান্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে।

সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে সারাবাংলা’কে বলেন, দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা একাট্টা। এখানে কোনো ছাড় নেই। আমরা সরকারের তরফ থেকে একাধিকবার বলেছি, দুর্নীতিবাজ সরকারি দলের হলেও তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা আমাদের দলে কোনো দুর্নীতিবাজ নেতা চাই না। তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করেছেন তারা আতঙ্কে থাকবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু দেখছি না। একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালের করা বানোয়াট নিউজের ভিত্তিতে দুদুক অভিযানে নেমেছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। যেহেতু আমরা কোনো অপরাধ করিনি সেহেতু বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো দুঃচিন্তাও করছি না।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা চাই দুর্নীতিবাজদের বিচার হোক। তারা যে দলেরই হোক বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমার দলের কেউ দুর্নীতি করলে, প্রমাণ থাকলে অবশ্যই তার বিচার হবে। এনিয়ে আমরা আতঙ্কিত নই।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুদক তদন্ত করছে। তদন্ত করা ভালো। আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। তাই তদন্ত করার দরকার আছে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়া দরকার। কিন্তু দুদককে নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন তাদের কার্যক্রমে কোনো পক্ষপাতিত্ব না থাকে। যারা দুদকের তদন্তের অভিযুক্ত হবে তাদেরকে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। না হলে দুদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুদককে মাথায় রাখতে হবে, দুদকের শক্তির মূল উৎস হচ্ছে জনগণ।

দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে এরইমধ্যে বেশকিছু রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনীতিবিদরা আছেন। গত ৪ এপ্রিল বিএনপির ৯ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। এই নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কার্যালয়ে তলব করা হবে। তার আগে এসব নেতাদের ব্যাংক হিসাবের সমস্ত তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

বিজ্ঞাপন

বিএনপির এই ৯ নেতা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাস,ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খান, আব্দুল আওয়াল মিন্টু এবং মিন্টু ছেলে তাবিথ আউয়াল। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে এ নেতাদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা শামসুল আলম। এছাড়া বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া এরইমধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় জেলে আছেন।

শুধু বিএনপি নয় এইমধ্যে সরকারি দলের বর্তমান এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাদেরও দুদক তলব করা শুরু করেছে। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন এমপিকে তলব করা হয়েছে। আরও কয়েকজন এমপি ও নেতার বিরুদ্ধে অনিয়মের তদন্ত চলছে। এছাড়াও ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ ব্যাংকটির পরিচালক মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর বিষয়েও তদন্ত চলছে।

একইসঙ্গে জাতীয় পাটির দুজন এমপির বিরুদ্ধেও তদন্ত চলমান রয়েছে। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে দুর্নীতির বিষয়ে নজর রাখছে সংস্থাটি।

দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য বি এইচ হারুন, খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান, নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার লিমিটেডের সভাপতি কামরুল আশরাফ খান, সরকার দলীয় হুইপ আতিউর রহমান আতিক। এছাড়াও দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে সাবেক গণপূর্ত ও গৃহায়ণ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত চলমান রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ও ময়মনসিংহ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি, জাপা নেতা নীলফামারী-৪ আসনের এমপি মো. শওকত চৌধুরীর বিরুদ্ধেও দুদকের তদন্ত চলছে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, শেরপুর-১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাসপোর্ট অফিস ও তিন আনি বাজারে বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয়, গ্রামের বাড়ি কামারিয়ায় ৩০ একরের বাগান বাড়ি তৈরি, ঢাকার বসুন্ধরা ও বনশ্রীতে দুটি প্লট, ধানমন্ডি ও গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট, নামে বেনামে সাত কোটি টাকা অর্জন, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা, স্কুল-কলেজের এমপিও থেকে মোটা অংকের টাকা অর্জনসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।

খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে খুলনা সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সরকারি অফিসের ঠিকাদারি, নিজ পরিবারের সদস্যদের নামে কাজ নিয়ে নামমাত্র কাজ করে বাকি টাকা আত্মসাৎ এবং মাদকের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

নরসিংদী-২ আসনের এমপি বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার লিমিটেডের সভাপতি কামরুল আশরাফ খানের বিরুদ্ধে ওই এলাকার এক ব্যক্তির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক কামরুল আশরাফকে তলব করে। দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লেখা চিঠিতে অভিযোগকারী উল্লেখ করেন, আমরা এ দেশের সাধারণ কৃষক। সরকার প্রতিবছর লাখ লাখ টন সার বিদেশ থেকে নিয়ে আসে। কামরুল আশরাফ ও তার সহচররা সার পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকে গত ১০ বছরে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

জানা গেছে, সরকারি ও বিরোধী দলের আরও কয়েকজন দুর্নীতিবাজ এমপি দুদকে তলবের ব্যাপারে পাইপলাইনে রয়েছেন। বিভিন্ন ক্যাটাগরি ধরে নেতা ও এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী হলফনামা ও বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করেই অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের এমপি থেকে কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ কেউই বাদ পড়ছেন না।

এর আগে ২০১৬ সালে সংস্থাটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, দুদক হবে দুর্নীতিবাজদের জন্য আতঙ্কের নাম। আর যারা দুর্নীতি করেন না তাদের জন্য দুদক হবে বটবৃক্ষ বা আশ্রয়স্থল।

সারাবাংলা/এমএইচ/এইচএ/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন