বিজ্ঞাপন

উৎসবের জোয়ারে শোক হয়েছে ম্লান!

February 21, 2022 | 10:30 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট

ঢাকা: অ, আ, ক, খ’র অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেসব তরুণপ্রাণ আন্দোলনে নেমেছিল, যারা বুলেটের চোখ রাঙানির কাছে বুক পেতে দিয়েছিল, যাদের রক্তে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল— সেই ভাষা শহিদদের অমরতা দিতেই শহিদ মিনার। বাংলা ভাষার চেতনার সন্তান রফিক, শফিক, সালাম, বরকতদের স্মরণেই পালিত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারি। কথা ছিল উত্তর প্রজন্মের কণ্ঠে ভেসে বাংলা মিশে যাবে স্মৃতির মিনারে। কিন্তু এখন একুশ এলে সেই স্মৃতির মিনারে উৎসবের জোয়ারে ম্লান হয়ে যায় শোক!

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার প্রতিবেদকের ক্যামেরা ও লেখায় সেই শোকের মোড়কে ‘উৎসবের চিত্র’ উঠে এসেছে। শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার ছলে কেউবা ব্যস্ত সেলফিতে, কেউবা ব্যস্ত খুনসুঁটি-আহ্লাদে, কারও পরনে শোক পালনের নামে ফ্যাশনের ঝলকানি।

মাইকে কিছুক্ষণ পরপরই ঘোষণা হচ্ছে ‘আপনারা শহিদ বেদিতে উঠে ফুল ছিটাবেন না। এটি উৎসব নয়। যথাযজ্ঞ ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখুন।’ ঘোষণার পরপর কিছুক্ষণ শৃঙ্খলা বজায় থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও শুরু উৎসব উদযাপন। ফুল বা পুষ্পস্তবক দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের চেয়েও ছবি তোলাটাই যেন প্রধান লক্ষ্য অনেকের।

২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রতিবছরের মতোই ভিড় দেখা যায়— কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। কিন্তু সেখান শোকের আবহের চেয়ে উৎসবমুখরতাই চোখে পড়ে বেশি। নানাবয়সী মানুষ শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে ফুল বা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বা না করে ছবি তোলা বা সেলফি তোলাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। সাজগোজ, মাথায় ফুলের মুকুট, হাসিখুশি পরিবেশ সব মিলিয়ে উৎসবমুখরতা দেখা যায় বেদি প্রাঙ্গণ ঘিরে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছরের মতোই রাত বারোটা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণের পর একে একে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতে শুরু হয় সাধারণ মানুষের ভিড়, যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

সকাল ১১টার পর ফুলার রোডের দিক থেকে করা প্রবেশপথে তখনও লম্বা লাইন। একসঙ্গে একই সংগঠনের ব্যানারে সর্বোচ্চ পাঁচ জন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবেন এমন নিয়ম থাকলেও অনেককেই সেই নিয়ম মানতে দেখা যায়নি। এ সময় অনেককেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহিদ মিনারে আসতে দেখা যায়। অনেকের সঙ্গে ছিল আলাদা করে ক্যামেরা পারসন যারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। আবার যারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করছেন তাদেরও নিয়ম অনুযায়ী ব্যানার গুটিয়ে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছবি তোলার কারণে অনেকেই দেরি করছিলেন। এতে পেছনে ভিড় বাড়ছিল। মাইকে বার বার বলার পরেও অনেককেই নিয়ম মানতে দেখা যায়নি।

বিজ্ঞাপন

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান শহিদ মিনার যে জায়গায় অবস্থিত সেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে নিহত ছাত্রদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই শহিদ মিনার। প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছিল অতি দ্রুত এবং নিতান্ত অপরিকল্পিতভাবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে রাতের মধ্যে তা শেষ করে।

২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রথমে শহিদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে ও পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন। সেদিনই পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহিদ মিনার তৈরি করা হয়, যা একসময় তৎকালীন সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।

অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পরে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৬৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের আরেক শহিদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম এটি উদ্বোধন করেন।

বিজ্ঞাপন

শহিদ মিনার তৈরিতে নানা বাধা বিপত্তি এলও ১৯৫৩ সাল থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা প্রভাতফেরী করে শহিদ মিনারে যাওয়া ও শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন চলে আসছে। ১৯৯৯ সালে বিশ্বের সব ভাষার প্রতি শদ্ধা জানাতে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আজকের দিনে দিবস পালনে ভাষা আন্দোলনের এই স্মৃতি বা শহিদ মিনারের তাৎপর্যের চেয়েও উৎসবমুখরতাই যেন প্রধান হয়ে দেখা যাচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমদ মনে করেন দিবস পালনের জায়গা থেকে সরে উদযাপনের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোনো গবেষণা না থাকলেও আমি মনে করি এর কারণ তারা ভাষা দিবসের তাৎপর্যই জানে না। জানে না ৫২-৬৯-৭১ অর্থাৎ ভাষা দিবস থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস।’

এই না জানার কারণ হিসেবে তিনি টানা কয়েক দশকের শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করেন, যারা বাংলাদেশের জন্মের প্রকৃত ইতিহাস প্রচার করেনি বা করতে বাধা দিয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত এদেশে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও মাতৃভাষার ইতিহাস ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেসময়ে বেড়ে ওঠা নাগরিকরা অনেকেই তাই ইতিহাস না জানার কারণে শ্রদ্ধাবোধ কিছুটা কম বলেই মনে করেন এই মনোবিদ।

লোকজন স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুলবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেখানে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখাটা জরুরি বলে মনে করেন মনোবিদ হেলাল উদ্দীন আহমদ। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্যও অনেকে ছবি তোলেন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে। সমাধান হিসেবে তিনি মনে করেন- শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শেখানোই যথেষ্ট নয়, পরিবার থেকেও শিশুদের মধ্যে নিজের দেশ, ভাষা ও ইতিহাসের গুরুত্ব শেখাতে হবে। শেখাতে হবে শ্রদ্ধাবোধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদেকা হালিম মনে করেন একুশে ফেব্রুয়ারির উদযপানে এই উৎসবমুখরতা আসার পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কারণ রয়েছে। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন স্কুলজীবন থেকেই তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যেতেন। তখন প্রভাতফেরী হতো। আর সেই প্রভাতফেরীতে যথাযোগ্য ভাবমর্যাদা বজায় রাখা হতো। কিন্তু এখন পোশাকি উদযাপন এত গুরুত্ব পাচ্ছে যে, শোক আর শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বিষয়টা পেছনে পড়ে গেছে।

সামরিক শাসকের আমলে প্রভাতফেরী মধ্যরাতে চলে আসে। এর ফলে ভোরবেলা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের যে মহিমা সেটি অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়াও পুঁজিবাদের কারণে একুশে ফেব্রুয়ারিও এখন উদযাপন হয় পোশাকি সমারহে। ফলে অনেকেই বুঝতে পারেন না আসলে এই দিবসের তাৎপর্য কী।

এই তাৎপর্য কমে যাওয়ার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা আছে বলে স্বীকার করেন তিনি। তার মতে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের নিয়ন্ত্রণে ঢাবি প্রশাসনের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। গত কয়েকবছর ধরেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সশরীরে না আসার পরেও যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ি দেখা যায়, তাতে মনে হয় এটি আর সাধারণের দিবস নেই।

আবার সারাবছর শহিদ মিনার যেভাবে উন্মুক্ত থাকে তাতে অনেককেই এর প্রতি শ্রদ্ধার মানসিকতা দেখায় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিভিন্ন মনুমেন্টে যেভাবে শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা হয় তা আমাদের এত গৌরবের শহিদ মিনারে এসে আর দেখা যায় না। দিবসটির মূল ভাবনা থেকে সরে এসে এর বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। কিন্তু ভাষা সৈনিকদের ত্যাগের মহিমা যেন বিস্মৃত হয়েছে।

সমাধান হিসেবে আমাদের সামাজিক আচরণের গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি শহিদ মিনারের যথেচ্ছা ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনার দাবি জানান এই শিক্ষক।

সারাবাংলা/আরএফ/একে/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন