বিজ্ঞাপন

মোবাইলে অর্ডার-ব্যাংকে লেনদেন কেড়ে নিয়েছে হালখাতার জৌলুস

April 13, 2018 | 9:23 am

।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সিলেটের মৌলভীবাজার কিংবা কক্সবাজারের টেকনাফ। দূর-দূরান্ত থেকে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা একসময় আসতেন দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের আড়ৎ খাতুনগঞ্জে। ব্যবাসায়ীরা চাহিদামতো পণ্যের অর্ডার দিতেন, নিয়ে যেতেন।

আড়তদারের ব্যবসায়িক নথি যেটা হালখাতা নামে পরিচিত, তাতে লেখা থাকত সেই ক্রেতার নাম এবং দেনাপাওনার হিসাব। বছর শেষে চৈত্র মাস এলে সেই ব্যবসায়ী আবারও ছুটে আসতেন চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর তীরের আড়ত এই খাতুনগঞ্জে। দেনাপাওনার হিসাব মিটিয়ে আড়তদারের হালখাতায় নিজের নামটি তুলতেন নতুন করে।

বৈশাখের প্রথমদিনে সেই ‘ক্রেতা নারায়ণকে’ দাওয়াত দিয়ে এনে আপ্যায়িত করতেন আড়তদার। চৈত্র মাসজুড়ে দেনাপাওনার হিসাব মেটানো এবং বৈশাখের প্রথমদিনে নতুন বছরের যাত্রা শুরুতে পুরো খাতুনগঞ্জে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে তৈরি হত উৎসবের আমেজ।

বিজ্ঞাপন

দিন পাল্টে গেছে। আড়তদারের ব্যবসা ছড়িয়ে গেছে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে। এখন চাহিদামতো পণ্যের অর্ডার দিতে এবং দেনাপাওনার হিসাব মেটাতে সশরীরে আর ক্রেতাকে খাতুনগঞ্জে আসতে হয় না। মোবাইলে দেন অর্ডার। ব্যাংকে জমা দেন টাকা। সশরীরে এলেও নগদ টাকার লেনদেন হয় না বললেই চলে। চেকের মাধ্যমে পরিশোধ হয় টাকা। এর ফলে হালখাতা তার গুরুত্ব হারিয়েছে অনেকটাই। হালখাতার উৎসবও তাই ম্রিয়মান।‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’- এই উক্তি যথার্থতা প্রমাণ হয় খাতুনগঞ্জের হালখাতা উৎসবের জৌলুস হারানো দেখে।

খাতুনগঞ্জের ডাল-ছোলার আড়তদার মেসার্স অর্পিতা ট্রেডার্সের পরিচালক সজীব দে সারাবাংলাকে বলেন, এখন অনলাইনের যুগ। কার এত দায় পড়েছে, কষ্ট করে খাতুনগঞ্জে এসে মালের (পণ্য) অর্ডার দেবে। এখন কাস্টমার মোবাইলেই বলে দেন উনার পাঁচ টন মসুর ডাল লাগবে কিংবা তিন টন ছোলা লাগবে। আমরা ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দিই। গ্রামগঞ্জে প্রাইভেট ব্যাংকের শাখা হয়ে গেছে। টাকা অ্যাকাউন্টে জমা হলেই আমরা ট্রাকে করে মাল পাঠিয়ে দিচ্ছি। হালখাতার তো এখন আর তেমন দরকার নেই।

বিজ্ঞাপন

ডাল-ছোলার আরেক আড়তদার এ এস ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী এস এম মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, চট্টগ্রামের কাছাকাছি থেকে অনেক কাস্টমার এখনও আসেন। কিন্তু নগদ টাকার লেনদেন হয় না। চেক দিয়ে যান। অনেক সময় অ্যাডভান্স চেকও দিয়ে যান। মাল পাঠানোর পর ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে সেই চেক ব্যাংকে জমা দিলে টাকা নগদ হয়ে যাচ্ছে। তবে এটা সংখ্যায় অনেক কম। মোবাইলের যুগে কাস্টমারের চেহারা এখন আমরা দুই বছর, তিন বছরে একবার দেখি কি না সন্দেহ আছে।

ব্যবসায়ীরা জানালেন, আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত হালখাতা উৎসব জমজমাট ছিল। এরপর থেকে ব্যবসা বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়। আশির দশকের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি করতে হত না। দেশীয় পণ্যই বিক্রি হত। এখন চাহিদা বেড়েছে, আড়তদাররা আমদানির দিকে ঝুঁকেছেন। এই সুযোগে ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেছে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে আড়তদারের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠতে থাকে। ফলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায় আস্তে আস্তে ভাটার টান পড়তে থাকে।

আশির দশকের পর হালখাতা খোলার বিষয়টি সার্বজনীন রূপও কিছুটা হারিয়ে ফেলে। সাধারণত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বৈশাখ থেকে চৈত্র অর্থাৎ বাংলাবর্ষ হিসেবে হালখাতা খোলেন। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা রমজান থেকে পরবর্তী রমজান মাস পর্যন্ত বছর হিসাব করে হালখাতা খোলেন। আবার আরেকশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা ব্যাংকিং পদ্ধতিতে জুলাই-জুন অর্থবছর হিসাব করে হালখাতা খোলেন। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরকে বছর ধরেও কেউ কেউ হালখাতা খোলেন।

বিজ্ঞাপন

তবে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মতে, এখনও ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ীই বৈশাখের প্রথমদিনেই নতুন হালখাতা খোলেন অর্থাৎ নতুনভাবে ব্যবসার হিসাব শুরু করেন।

বর্তমানে হালখাতার হালচাল:

প্রায় ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করে আসা মেসার্স সুমন ট্রেডিংয়ের স্বত্তাধিকারী সঞ্জয় দেব খোকন সারাবাংলাকে বলেন, এখন আর আগের মতো নগদ টাকার হিসাব হয়ত হয় না। তবে নিজের প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের হিসাব রাখতে হালখাতা লাগে। তুলনামূলকভাবে কম হলেও সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখনও হালখাতার ব্যবহার আছে।  তবে হালখাতার উৎসবটা আগে জাতীয় উৎসব ছিল। এখন সেটার জৌলুস কমে গেছে।

তিনি বলেন, আগে চৈত্র মাসে কাস্টমররা যখন দেনাপাওনা মেটাতে আসতেন, তাদের আমরা আপ্যায়ন করতাম। বিভিন্ন ধরনের উপহার দিতাম। বৈশাখের প্রথমদিন কে হিন্দু, কে মুসলমান, সে ভেদাভেদ ছিল না। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দোকানে মিষ্টি পাঠাত। এখন আর সেই উৎসবের আমেজ নেই।

এস এম মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা বাংলা বছর হিসাব করি দিনপঞ্জিকার মতামত অনুসারে। কিন্তু সরকারী হিসেবের সঙ্গে আমাদের একদিন গরমিল হয়। সরকারীভাবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হয়। দিনপঞ্জিকার হিসেবে আমাদের করতে হয় একদিন পর। সেদিন আবার অফিস-আদালত সব খোলা। খোলার দিনে তো উৎসব জমে না।

মেসার্স নূর ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মো.কামরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসাটা হচ্ছে বিশ্বাসনির্ভর। মুখের কথায় লাখ লাখ টাকা বাকি অথবা নগদে লেনদেন হচ্ছে। এখানে বেশকিছু প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এরপর বিশ্বাসনির্ভর এই ব্যবসায় জড়িতদের মধ্যে আগের সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কও নষ্ট হয়েছে। সেই অর্থে সার্বজনীন উৎসব হালখাতা এখন আর নেই।

এবার আসা যাক ব্যবসায়িক খাতা কিংবা হালখাতা যারা তৈরি করেন তাদের কাছে। খাতুনগঞ্জ থেকে আনুমানিক দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে টেরিবাবাজারের মুখে কাটাপাহাড় বাই লেন। সেখানে আছে প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো হালখাতা তৈরির দোকান দি খাতাঘর। তাদের কাছে পাওয়া যায় শুধুই ব্যবসায়িক খাতা বা হালখাতা।

খাতাঘরে হালখাতার মধ্যে আছে রয়েল ডে বুক, রেজিস্টার, জাবেদা, রাফ খাতা, লেজার ডে বুক, লেজার রেজিস্টার, অফসেট রেজিস্টারসহ কমপক্ষে ৪০ ধরনের আইটেম। সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা দামের খাতাও আছে। এর মধ্যে ডে বুক আর রেজিস্টারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন দি খাতাঘরের মালিকদের একজন লিটন ঘোষ।

হালখাতা আর সাধারণ খাতার পার্থক্য বোঝালেন এই ব্যবসায়ী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, হালখাতা মানে হচ্ছে সারাবছরের হিসাব। এটা প্রতিদিন খুলতে হবে, বাঁধতে হবে। সুতরাং বাধাইটাও মজবুত হতে হবে যেগুলো স্কুল-কলেজের খাতার মতো হলে হবে না। আমরা এই বাধাইটা নিশ্চিত করি।

লিটন ঘোষ সারাবাংলাকে জানান, হালখাতার চাহিদা কিছুটা কমে গেছে। আগে খাতুনগঞ্জ থেকেই চৈত্র মাসে অন্তত ৫ লাখ টাকার অর্ডার পাওয়া যেত। সিলেট-বগুড়া থেকেও অর্ডার আসত। এখন হালখাতা বিক্রি হয় শুধু চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার মতো হালখাতা বিক্রি হয় চৈত্র মাসে।

সারাবাংলা/আরডি/এমএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন