বিজ্ঞাপন

যুদ্ধের এক মাস— ইউক্রেনের শিশুদের অর্ধেকই ঘরছাড়া

March 25, 2022 | 10:03 pm

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

দেখতে দেখতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের এক মাস পেরিয়ে গেছে। এই এক মাসে যেমন উভয় পক্ষে প্রাণহানি হয়েছে, তেমনি ইউক্রেনের জনজীবনে পড়েছে ব্যাপক প্রভাব। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই যুদ্ধ নিয়ে এসেছে চরম সংকট। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর এক মাসের মাথায় দেশটির ৭৫ লাখ শিশুর ৪৩ লাখই বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ শিশুকে প্রাণ বাঁচাতে পাড়ি জমাতে হয়েছে সীমানা অতিক্রম করে দেশের বাইরে। বাকি ২৫ লাখ শিশু দেশে থাকলেও ছাড়তে হয়েছে নিজেদের ভিটেমাটি।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক মাসের মাথায় জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক বিবৃতিতে এ তথ্য উঠে এসেছে। যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য মৌলিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার কারণেই শিশুদের এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে বলে মনে করছে ইউনিসেফ।

সংস্থাটির প্রধান ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও এই যুদ্ধে প্রচুর শিশু হতাহত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওএইচসিএইচআরের হিসাব বলছে, যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৭৮টি শিশু মারা গেছে। আহত হয়েছে আরও ১০৫টি শিশু। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে শিশু হতাহতের এই সংখ্যা নিশ্চিত করা হলেও শিশু হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিশুদের প্রতি নৃশংসতার এ চিত্র তুলে ধরে একে ‘আশঙ্কাজনক নজির’ হিসেবে উল্লেখ করে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষে করছে বলে সবাইকে সতর্ক করেন ক্যাথেরিন। বলেন, শিশুদের এই মুহূর্তে শান্তি ও নিরাপত্তা দরকার। দরকার তাদের অধিকার। যত দ্রুতসম্ভব গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে ও শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, গত চার সপ্তাহে ইউক্রেনজুড়ে ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, দেশটিতে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চিকিৎসা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহারের সুযোগও কমে গেছে। এটি সারাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

ইউনিসেফ কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব ভবন, বিশেষ করে হাসপাতাল, স্কুলভবন ও বেসামরিক জনগণের আশ্রয়স্থলগুলোতে কখনোই হামলা করা উচিত না। কিন্তু ইউক্রেনে এসব ভবনে নিয়মিত হামলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে নিরাপদ পানির অভাবে রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। আরও ৪৬ লাখ মানুষ পানির সংকটে রয়েছে, যাদের পানি সরবরাহ যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ছয় মাস থেকে দুই বছরের বছরের কম বয়সী প্রায় সাড়ে চার লাখ শিশু ভুগছে পরিপূরক খাদ্যের অভাবে।

ক্যাথেরিন বলেন, শিশুদের নিরাপত্তা, সুস্থতা ও প্রয়োজনীয় পরিসেবাগুলোর প্রাপ্যতা হুমকির মুখে। এ পরিস্থিতি ভয়ংকর। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের জন্য জরুরি শান্তি ও নিরাপত্তা দরকার বলে মনে করছে জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো।

বিজ্ঞাপন

অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএমের মতে, আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন দীর্ঘাস্থায়ী দুরারোগ্য রোগে ভুগে থাকেন, যা অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের স্বাস্থ্যকে আরও নাজুক করে দেয়। এছাড়াও হাম ও পোলিওসহ যেসব রোগ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য, সেসব রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়তে পারে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে ইউক্রেনের শিশুদের জন্য এমন ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

ইউনিসেফ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো ইউক্রেন ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনের শিশুদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিয়েভ, খারকিভ, নিপ্রোসহ ইউক্রেনের ৯টি এলাকার ৪৯টি হাসপাতালের চার লাখ মা, নবজাতক ও শিশুদের কাছে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করেছে তারা। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো অবরোধ অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে পানি ও স্বাস্থ্যপণ্য সরবরাহের পাশাপাশি ভয়াবহ যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে ভ্রাম্যমাণ শিশু সুরক্ষা দলের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আসন্ন সপ্তাহগুলোতে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা পরিবারগুলোর কাছে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়া এবং শিশুবান্ধব জায়গা তৈরিতে কাজ করবে বলেও জানিয়েছে ইউনিসেফ।

এছাড়াও ইউক্রেন ছাড়তে বাধ্য হওয়া লাখো পরিবারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে ইউনিসেফ ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। শরণার্থীদের জায়গা দেওয়া দেশগুলোর সরকার ও সুশীল সমাজের সঙ্গে মিলে দেশগুলোর সীমান্তে বিশেষ নিরাপদ স্থান তৈরি করছে। ‘ব্লু ডট’ নামক এসব স্থান দিয়ে শিশু ও অন্যান্য শরণার্থীরা নিরাপদে পার হতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

শরণার্থী পরিবারগুলোতে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া, নিঃসঙ্গ ও বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া শিশুদের নিরপদে পৌঁছাতে সাহায্য করাসহ শিশুদের যৌনতার জন্য পাচারের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতেও কাজ করছে সংস্থাগুলো। ইউক্রেনের অধিবাসীদের আশ্রয় দেওয়া এমন ‘ব্লু ডটে’র সংখ্যা আরও বাড়ানোর প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। কেবল পোল্যান্ডেই আরও ২০টিরও বেশি নিরাপদ স্থান ‘ব্লু ডট’ তৈরি করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

ইউনিসেফ আরও জানায়, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত শিশুরা পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘের অপরাধ ও মাদক বিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসি এসব শিশুদের অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে।

ইউএনওডিসি’র নির্বাহী পরিচালক গাডা ওয়ালি বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির চিত্র বলছে, অপরাধচক্র যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে সুবিধা নেয়। সংঘাত অসহায়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় এবং একইসঙ্গে বিপদগ্রস্ত, আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার মানুষ ও শরণার্থীরা অপরাধচক্রের হাতে পড়ার আশঙ্কায় থাকে।

ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, ইউক্রেন ছেড়ে আসা মানুষের মধ্যে ৩৬ লাখ অর্থাৎ মোট শরণার্থীর ৯০ শতাংশই নারী ও শিশু, যারা সবচেয়ে বেশি পাচার ও অন্যান্য বিপদের ঝুঁকিতে আছে। গাডা ওয়ালি বলেন, সংঘাত যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, এসব ব্যক্তির পরিস্থিতি তত জটিল হয় ও তাদের জন্য নতুন করে জীবন শুরু করা কঠিন হয়ে যায়।

ইউএনওডিসি’র মানবপাচার ও শরণার্থী স্মাগলিং শাখার প্রধান ইলিয়াস চ্যাটজিস বলেন, যুদ্ধ থেকে পালানো মানুষ সবসময়ই চরম বিপদের মধ্যে থাকে। ইউক্রেন ছেড়ে আসা অনেক নারীর সঙ্গেই পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক কোনো সদস্য নেই। আবার অনেক অভিভাবকবিহীন শিশুও একা একা ভ্রমণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ও মিথ্যা চাকরির লোভ দেখিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া খুবই সহজ। পাচারকারীরা এমন অনেক পদ্ধতি ও চালাকির মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত মানুষকে ফাঁদে ফেলে থাকে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন