বিজ্ঞাপন

১৯৭১ গণহত্যার সংবাদ ছবির গল্প

April 5, 2022 | 1:19 pm

রাহাত মিনহাজ

পাশাপাশি দুটো রিক্সা। রিক্সা দুটোর উপর তিনটি মরদেহ। দেহগুলো গুলিতে ছিন্নভিন্ন। রক্তাক্ত শরীর। বুক, পেট, কোমর ও হাতে ছোপ ছোপ রক্ত ধারা। হাতগুলো ছরানো। অসহায়, বেতনার্ত, যন্ত্রণা দগ্ধ মুখাবয়। সাদাকালো এই ছবিটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের একটি আইকনিক ছবি হিসেবে সুপরিচিত। বাংলার মাটিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তার সাক্ষ্য বহন করে এই ছবিটি। পাক সেনাবাহিনীর বর্বরতার নিদর্শন হিসেবে এই ছবিটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত। শুধু সংবাদ মাধ্যমই নয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনাতেও এই ছবিটি গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়। আসুন ঐতিহাসিক এই সংবাদ ছবিটি (News photo) সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানার চেষ্টা করা যাক।

বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিক এই ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতাভিত্তিক ভারতের জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্যা স্টেটস্ম্যান (The Statesman) সংবাদপত্রে, ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল। উল্লেখ করা যেতে পারে দ্যা স্টেটস্ম্যান ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র। এই সংবাদপত্রটি যাত্রা শুরু করে ১৮৭৫ সালে। পত্রিকাটির প্রধান কার্যলয় কলকাতার চৌরঙ্গি স্কয়ারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সংবাদপত্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত এই ছবিটি তোলেন সংবাদপত্রটির ফটোসাংবাদিক অমিয় তরফদার (Amiya Tarafdar)। এই ছবির ক্যাপশন ছিল ‘ÔCycle rickshaw pullers and their passengers shot dead by Pakistani troops on the way to Saidpur, in Dinajpur’। এদিন দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম পাতাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। যাতে শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশের চিত্র ছিল। আর সংবাদপত্রজুড়েই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর। প্রধান শিরোনাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আর অন্যান্য খবরও ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।

বিজ্ঞাপন

ফটোসাংবাদিক অমিয় তরফদার এই ছবি সম্পর্কে কথা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. চৌধুরি শহীদ কাদেরের সাথে। তিনি তার পিএইচডি গবেষণার কাজে ১৯৭১ সালে ভারতের বিশেষ করে কলকাতার সংবাদপত্র নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন। এ ছবিটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই ছবিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি জেনোসাইডের সাক্ষ্য বহন করে। শুরুর দিকে এই ছবিটি নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা ছিল। ছবিটি কে তুলেছেন, কোথায় তোলা হয়েছে সে সব বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু আমি আমার গবেষণা করতে গিয়ে কলকাতায় দ্যা স্টেটস্ম্যান পত্রিকার কার্যালয়ে গিয়ে ছবিটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। ছবিটা তুলেছন ফটোসাংবাদিক অমিয় তরফদার। ১৯৭১ সালে অমিয় তরফদার একইসাথে কয়েকটি পত্রিকায় ছবি দিতেন। সংবাদপত্রগুলোতে তার নামে ছবিগুলো প্রকাশিত হতো। এই ছবিটি প্রথম প্রকাশিত হয় দ্যা স্টেটসম্যান সংবাদপত্রে। এরপর এই ছবিটি অনেক আঞ্চলিক সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। আসাম থেকে প্রকাশিত পত্রিকা যুগশক্তিতে ১৯৭১ সালের মে মাসে আবার এই ছবিটি প্রকাশিত হয়। আলোকচিত্রী হিসেবে নাম লেখা হয় অমিয় তরফদার।

এই ছবির চিত্রগ্রাহক ফটোসাংবাদিক অমিয় তরফদার সম্পর্কে আর কি জানা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কাজের পরিধি বা অবদান কেমন ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে গবেষক ড. চৌধুরি শহীদ কাদের জানান, আমি যতদূর জানি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ ছবি তুলেছেন। তিনি হয়তো প্রথম দিকে হিলি হয়ে দিনাজপুর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হয়তো নিরাপত্তার কারণে পুরোপুরি ঢুকতে পারেননি। আর তাই ভারতে ফিরে আসার পথে তিনি সৈয়দপুরে ঐ ছবিটি তোলার সুযোগ পান। এছাড়া তার অন্যান্য ছবি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যশোর, খুলনা ও কলকতার সংলগ্ন বনগাঁও এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক ছবি তিনি তুলেছেন। এরমধ্যে ছিল শরণার্থীদের দুর্দশা ও স্থানীয় জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চিত্র আছে। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক ছবি তিনি তার ক্যামেরায় ধারণ করেন। যেগুলো এখন ইতিহাসের অংশ, গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এছাড়া যতদূর জানা যায়, গুণী এই ফটোসাংবাদিক আনন্দবাজার, যুগান্তর ও বসুমতি সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন বাঙালি সরম সাংবাদিক, একজন ক্যামেরা যোদ্ধা।

বিজ্ঞাপন

গুণী ফটো সাংবাদিক অমিয় তরফদার ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাকে বিশেষ সম্মাননা জানায় ২০১৫ সালে। অমিয় তরফদারের হয়ে সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন তার ভাই শেখর তরফদার। ঐ সময় শেখর তরফদার জানান, তাদের বাড়ি ছিল রাজশাহীতে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই তার দাদা (অমিয় তরফদার) সীমান্তে চলে আসেন। তিনি জানান, ১৯৭১ সালে আমরা থাকতাম দক্ষিণ দিনাজপুরে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই দাদা চলে যান বাংলাদেশ অংশের দিনাজপুরে। তারপর ছবি আসা শুরু করলো। ছবির ফিল্ম। সেগুলো আমরা আমাদের নিজেদের স্টুডিও’তে ডেভোলোপ করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠাতাম। এরইমধ্যেই দাদা একটা মারাত্মক ছবি পাঠালেন। রিক্সা-ভ্যানে ডেডবডির ছবি। এই ছবিটি নিয়ে আলোড়ন তৈরি হলো। কলকাতায় ইংরেজিসহ কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হলো। এরপর আমার কাছে ফোন এলো নিউজউইক থেকে। তারা ছবিটি চাইলো। আমি ছবিটিকে রেডিও ফটো করে পাঠালাম নিউজউইক এ। পরে এই ছবিটি টাইম ম্যাগাজিনও চাইলো। এই ছবিটির ভীষণ চাহিদা ছিল।

শেখর তরফদার জানান, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন অমিয় তরফদার ঢাকায় ছিলেন। ঐ দিন ছবি তোলার সময় প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে অমিয় তরফদারের পা ভেঙ্গে যায়। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়নে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন