বিজ্ঞাপন

‘মাতারবাড়ি প্রকল্পে কার্বন বিপর্যয়ে অকালে ঝরবে ৬৭০০ প্রাণ’

May 16, 2022 | 8:44 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নির্মিত হলে চট্টগ্রামের মাতারবাড়ি-১ ও ২ প্রকল্পের বায়ু দূষণের ফলে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া এই দুইটি প্রকল্পসহ চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৭টি জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্প থেকে ১৩৮ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হবে। প্রকল্পগুলো কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় ব্যাপক আকারে বায়ু দূষণের কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এক সমন্বিত প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত ২০ গিগাওয়াট নতুন কয়লা ও গ্যাস বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো চালু হলে স্থানীয় বাস্তুবিদ্যা; জলপথ, সম্প্রদায় ও জীবিকা; এবং স্বাস্থ্য ও জলবায়ুর জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি তৈরি হবে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

সোমবার (১৬ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে জ্বালানি উৎপাদন পরিকল্পনা: সম্ভাব্য কার্বন বিপর্যয়’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠান মার্কেট ফোর্সেস, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ মিলিতিভাবে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের জন্য একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (Strategic Environmental Assessment) অবিলম্বে নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।

বিজ্ঞাপন

বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদের সভাপতিত্বে এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মার্কেট ফোর্সেস’র নির্বাহী পরিচালক জুলিয়ান ভিনসেন্ট। প্রতিবেদনের ওপর মতামত দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জাপানি প্রতিষ্ঠান জকেসাস’র প্রোগ্রাম অডিনেটর ইউকি তানবে ও সঞ্চালনা করেন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রস্তাবিত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই চট্টগ্রাম বিভাগে। ফলে অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম বড় কার্বন নিঃসরণক্ষেত্র হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। মিতসুবিশি করপোরেশন, জেরা, জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থে দূষিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে জিম্মি করে রেখেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদন প্রকাশ করে জুলিয়ান ভিনসেন্ট বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর ওপর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রভাব হবে ভয়ংকর। বাস্তবায়ন করা গেলে প্রকল্পগুলো থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমপরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হবে, যা জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের কার্বন নির্গমনের সমান।

বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, মিতসুবিশি, জেরা ও জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের খরচের প্রতি সামান্য বিবেচনা না করেই এসব প্রকল্পগুলোর জন্য চাপ দিচ্ছে, যেন তারা ‘বিষাক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে’র সম্প্রসারণ থেকে লাভবান হতে পারে। এসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশিরা পরিষ্কার, সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানিতে বিনিয়োগ চায়, দূষিত এবং ব্যয়বহুল এলএনজি নয়।

জাপান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ইউকি তানাবে বলেন, জাপানি সংস্থা সুমিতোমো করপোরেশন মাতারবাড়ি ২ কয়লা প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জাপানি বেসরকারি ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারীরা নাটকীয়ভাবে তাদের জলবায়ু নীতিগুলো শক্তিশালী করছে। কয়লা ও গ্যাস প্রকল্পগুলো শিগগিরই অর্থায়নযোগ্য হবে না, এমনকি জাপানি বিনিয়োগকারীদের দ্বারা হলেও।

সিপিডি’র গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যদি এনডিসি বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে এখনই জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। কয়লা ও আমদানি করা গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত সম্প্রসারণ করছে, সেই সহযোগিতা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের মাধ্যমে করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সভাপতির বক্তব্যে বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক ও ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ বলেন, আগে আমাদের মূল লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তারপর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দূষণমুক্ত টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্মোহ বাস্তবায়ন করতে হব। সরকার কি পরিবেশ ধ্বংস করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় নাকি দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি অক্ষুণ্ন রেখে স্থায়িত্বশীল নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর দেশে পরিণত হতে চায়— এটিই ভাবার বিষয়।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে নতুন কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে চাইলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্টরা বলেন, আইইএ’র এমন সতর্কবার্তা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের নতুন পরিকল্পনা নিচ্ছে। সংস্থাটির মতে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তো বটেই, এমনকি এরই মধ্যে চালু হওয়া গ্যাস (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিকর ১২শ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার মাতারবাড়ি-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে জাপানি কোম্পানিগুলো, যা দেশটির ২০২১ সালের জি-সেভেন সম্মেলনে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন না করার অঙ্গীকারের সম্পূর্ণ বিপরীত। মাতারবাড়ি-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও এরই মধ্যে স্থানীয় জলাশয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনা নির্মাণের জন্য সাধারণ মানুষকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তারা জীবন-জীবিকাও হারিয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতেই বাংলাদেশের বার্ষিক খরচ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮৪০ কোটি মার্কিন ডলারে। এলএনজি থেকে প্রতি গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ হবে গড়ে ৯৬ কোটি মার্কিন ডলার। ফলে দেশের অর্থনীতি বেশি দামে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাছাড়া আপাতদৃষ্টিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো এসব খরচ বহন করলেও পরিশেষে দেশের সাধারণ মানুষকেই এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি সংকটের সমাধান না খুঁজে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সমালোচনা করে বলা হয়, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ওভার ক্যাপাসিটির সমস্যা রয়েছে। ২০২০-২০২১ সালে ইনস্টল করা ক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়নি।

আয়োজনে পরিবেশবিদরা বলেন, বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যয়বহুল ও পরিবেশ ধ্বংসকারী জ্বালানির প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ এসব উৎস কাজে লাগিয়ে নিজের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে পারে। জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশকে পরিবেশ দূষণকারী প্রযুক্তি গছিয়ে না দিয়ে সাশ্রয়ী, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশটির প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সহায়তা করা।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন