বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন ও আজকের বাংলাদেশ

May 17, 2022 | 2:18 pm

নাজমূল হুদা ওয়ারেছী

ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের বিষয়ের পূর্বে আমি বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে অতি স্বল্প অবতারণা করতে চাই। সাম্প্রতিক খবর খবর অনুযায়ী, অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘনবসতিপূর্ণ ও আর্থিক সক্ষমতায় তাবৎ বিশ্বের রথী-মহারথী সুপার পাওয়ার দেশগুলোকে পেছনে ফেলে ‘সুপারম্যান’ নেতৃত্বগুণে কোভিড মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ম ও এশিয়ায় প্রথম হওয়ার অতি বিরল গৌরবের অধিকারী হয়েছে। আর এই ‘সুপারম্যান’ নেতৃত্বগুণের পরিচয় আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। সারাবিশ্বে আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার জয়ধ্বনী। -গত ১২ মে ২০২২ জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিকেই এশিয়া প্রকাশিত ‘নিকেই কোভিড–১৯ রিকোভারি সূচক’–এ এই চিত্র উঠে এসেছে। সূচকে বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে কাতার। এরপরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কম্বোডিয়া ও রুয়ান্ডা। তারপরেই বাংলাদেশের অবস্থান। কয়েকমাসের মধ্যে বিশ্বের আরেক বিস্ময় বিদেশী অর্থ মুক্ত শেখ হাসিনার একক অদম্য ইচ্ছার ফল পদ্মা সেতু জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন অনেক আগেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পূর্বপুরুষ ভিটা কেনিয়া সফরকালে দেশটিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করে অগ্রসর হতে বলেছেন। বাংলাদেশ সফরকালে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব এন্টিনিও গুটেরেসও একই কথা পূনর্ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানী সাংবাদিক ইমরান খানকে বাংলাদেশের মডেল অনুসরণ করতে বলেছিলেন পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইমরান খান নিজেও বাংলাদেশকে অনুসরণের ব্যপারে জনগনের সামনে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ সূচকের প্রায় সবগুলোৎ লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করেছে। এই মহা অসম্ভব সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র একজন বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য। এই অসম্ভবকে বাস্তবে রুপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, কেবলমাত্র একজন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার জন্য। শেখ হাসিনা সেদিন দেশে প্রত্যাবর্তন না করতে পারলে আজকের মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ আমরা পেতাম না।

সেদিনের প্রত্যাবর্তন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনার বিষয়টি আনি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলতে আমরা ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করাকে বুঝি। মুক্ত মাতৃভূমিতে ফিরে আসার ঘটনাটি ছিলো বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের পরিপূর্ণতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টানা কয়েক বছর জাতি হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। জাতিকে যখন আশা দেয়ার মতো কেউ ছিল না, ঠিক তখনই ভরসাস্থল হয়ে ক্ষত পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তারিখটা ছিল ১৭ মে ১৯৮১, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৮। রবিবার। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতায় তখন খুনী মোশতাকের সহচর জেনারেল জিয়া। তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে আশার সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।

১৯০৫ সালে লেখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতোই ৪২ বছর আগে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি স্ব-ভূমে ফিরতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। আপনজন চলে গেছে, পথে আঁধার আছে– তাতে কী! সব ভয়-সংশয় ভুলে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দেশে এসেছিলেন বঙ্গকন্যা। ১৯৮১ সালের ১১ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি।’ তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’

বিজ্ঞাপন

৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিদেশ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দুই বোনের আর্থিক সম্বল বলতে ছিল কেবল ২৫ ডলার। স্বামীর জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৫ আগস্ট স্বামী, বোন ও দুই সন্তানসহ দিল্লিতে পৌছান শেখ হাসিনা। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা, দুই সপ্তাহ দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে থাকার পর ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষাৎ পান তারা। তখন বিস্তারিত ঘটনা জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে দু’জন নিরাপত্তাকর্মীসহ থাকার নতুন ঠিকানা হয় ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন পান্ডারা পার্ক, সি-ব্লক ফ্ল্যাটে।

৭৫ সালের ১ অক্টোবর এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে স্বল্প বেতনে ফেলোশীপ দেয় ভারত সরকার। ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানা লন্ডন প্রবাসী শফিক সিদ্দিক-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে লন্ডন চলে যান। ১৯৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনার সাথে স্বাক্ষাৎ ও বৈঠক এর উদ্দেশ্যে দিল্লিতে যান শীর্ষনেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু। আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকন্যার সাথে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক। ৮০ সালের ৪ এপ্রিল এসব বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা করতে একমাত্র বোনের সাথে দেখা করতে লন্ডন যান শেখ হাসিনা।

পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। লন্ডন থেকে ফেরার পর দিল্লিতে বসে নিজের সভাপতি নির্বাচিত হবার খবর পান শেখ হাসিনা। ২৪ ফেব্রুয়ারী শীর্ষনেতা আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, জোহরা তাজউদ্দীন, স্বামী গোলাম আলী চৌধুরীসহ সাজেদা চৌধুরী, আমু, রাজ্জাক, তোফায়েল ও আইভি রহমান তারা দিল্লি যান শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করতে। সাজেদা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন রয়ে যান দেশে ফেরার তারিখ চূড়ান্ত করতে। মার্চে ২/৩ টা তারিখ করেও জিয়া সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং সে কারনে স্বামী মত না দেওয়ায় তখন দেশে ফেরা হয়নি। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ মে পুতুলকে নিয়ে রওনা হয়ে কলকাতা হয়ে ১৭ মে সফরসঙ্গী আব্দুস ছামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলীকে নিয়ে নিজ মাতৃভূমির কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। ইন্ডিয়া বোয়িং এয়ারলাইন্সে, সময় বিকাল সাড়ে ৪টা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সেদিন বাতাসের গতিবেগ ছিলো ৬৫ মাইল প্রতি ঘণ্টা। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছিল শেরে বাংলা নগর হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত। গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছিলো রাজপথ।

বিজ্ঞাপন

শেরে বাংলা নগরের বিশাল জনসমাবেশে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে জনগণের সামনে আসিনি। আমি আপনাদের বোন, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে বিরুদ্ধ শক্তিরা এখন পর্যন্ত ১৯ বার তাকে হত্যা চেষ্টা চালায়। বাংলার মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা-আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজও তিনি আমাদের মাঝে আছেন। আজও তিনি বাস্তবায়ন করে চলেছেন তার প্রতিশ্রুতি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ‘রুপকল্প-২০২১’ এর মধ্যম আয়ের দেশকে ‘রুপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বিনিদ্র, বিরামহীন কাজ করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: রাজনীতিবিদ

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন