বিজ্ঞাপন

নদীর তলদেশ স্পর্শ করে যেভাবে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতুর খুঁটি

June 25, 2022 | 12:17 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হচ্ছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যে ক্ষণটি দেশের গোটা একটি অঞ্চলকে যুক্ত করবে আরেকটি অঞ্চলের সঙ্গে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে স্বপ্নের সেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। তবে স্বপ্নপূরণের এই কর্মযজ্ঞ সহজ ছিল না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত সেতু নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে পদ্মা সেতুর খুঁটি গড়ে তোলা ছিল সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ ছিল নদীর তলদেশের ব্যাতিক্রমী মাটির লেভেল। পদ্মা তার পানির স্রোতের সঙ্গে নিচ থেকে বিপুল পরিমাণে মাটি তুলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে নদীর নিচের মাটি ক্ষয় হতে পারে ৬৫ মিটার বা প্রায় ২১৩ ফুট, যা ২১ তলা দালানের সমান। যে কারণে এই প্রমত্তা নদীর বুকে সেতু গড়তে হলে খুঁটি নিতে হতো আরও গভীরে।

এই জটিল কারিগরি দিক বের করতে পদ্মার কাজ পিছিয়ে গিয়েছিল প্রায় এক বছর। এ রকম ক্ষয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল ২২ খুঁটির তলদেশে। এ কারণে ২২টি খুঁটির কাজ বন্ধ রেখে পুনরায় নকশা করে আনতে হয়েছিল। বিষয়টি জানিয়েছিলেন পদ্মাসেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রধান প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।

বিজ্ঞাপন

জটিল এই সমস্যার সমাধানও করা হয় অভিনব পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতির ব্যাখা করে ড. জামিলুর সারাবাংলাকে জানিয়েছিলেন, নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটি বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথা হয়েছে। বিশেষ এ পদ্ধতির নাম স্ক্রিন গ্রাউটিং। এই পদ্ধতির প্রয়োগ বিশ্বে বিরল।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, এরকম পদ্ধতির ব্যবহারের নমুনা বিশ্বে খুব একটা নেই। এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির গুণাগুণ শক্ত করে তারপর সেখানে খুঁটি গাঁথা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পদ্মাসেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছিল সেতুর পাইল ড্রাইভিং নিয়ে। সেতু নির্মাণের আগে নদীর তলদেশের মাটি সম্পর্কে যে ধারণা করা হয়েছিল বাস্তবে কাজ শুরুর পর সেই ধারণার সঙ্গে মেলেনি। কাজ শুরু করতে গিয়ে নদীর নিচে মাটির যে স্তর পাওয়া গেছে, তা পিলার গেঁথে রাখার উপযোগী ছিল না। এ অবস্থায় দু’টি পথ খোলা ছিল— প্রথমত, পাইল নিয়ে যেতে হতো আরও গভীরে, না হলে সেতু ভেঙে বা দেবে যেতে পারে; দ্বিতীয়ত, গভীরতা কমিয়ে পাইল সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হতো।

প্রথম পদ্ধতিটির প্রয়োগ পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না। কারণ বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তির হ্যামার দিয়েও এত গভীরে পাইল ড্রাইভিং করার সুযোগ ছিল না। যে হ্যামার পদ্মা সেতুর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেই ড্রাইভিং করা হয়েছিল। নদীর আরও গভীরে, অর্থাৎ ১৩০ মিটার নিচে পাইল নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল, এই হ্যামার দিয়েও সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে নতুন আরেকটি হ্যামার আনতে হতো এবং সে ধরনের হ্যামার জার্মানি থেকে তৈরি করে আনতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগত। এ অবস্থায় নানা প্রতিকূলতায় এমনিতেই পিছিয়ে যাওয়া পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে আরও দেরি হতো।

এসব বিবেচনাতেই দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অবলম্বন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা এমন একটি পদ্ধতির দিকে যান, যা বিশ্বে বিরল। এ পদ্ধতিতে নদীর তলদেশে মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ড্রাইভিং করতে হতো। এমন পদ্ধতি বিশ্বে বিরল হলেও সেটিরই সফল প্রয়োগ করে বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

ওই পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়ে ড. জামিলুর বলছিলেন, পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়েছিল। আর পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। আর তখন সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। এরপর এসব পাইল লোড বহনের সক্ষমতা তৈরি হয়। আর এ পদ্ধতিটির নাম স্কিন গ্রাউটিং।

পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১১টি খুঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৌশলবিদ্যার এমন বিরল নজির বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও প্রকৌশল খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছে বিস্ময় হয়েই এসেছে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু টেস্ট পাইলিং কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। একবছর পর মূল পাইল ড্রাইভ শুরু হয়। এরপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর তিন বছর পর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সবশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয়। এর দেড় বছরের মাথাতেই যানচলাচলের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আজকের দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর আগামীকালই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সেই সেতুটি।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন