বিজ্ঞাপন

সারাবাংলায় সংবাদ প্রকাশ: ক্যাপ্টেন আজিজুলের পদত্যাগপত্র বিমানে!

June 28, 2022 | 7:40 pm

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বাংলাদেশ বিমানে বৈমানিক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি বৈমানিক সংকটের কারণে ১৪ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিমান। কিন্তু এই নিয়োগ নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ১৪ বৈমানিকের নিয়োগ নিয়ে ইতোমধ্যে সারাবাংলা ডটনেটে ধারাবাহিক কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ২২ জুন ‘লাইসেন্সহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারীদের বিমানে নিয়োগ’ প্রতিবেদনটি সারাবাংলায় প্রকাশিত হয়। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই বাংলাদেশ বিমানে নিজেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন সম্প্রতি বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। বিমান বাংলাদেশ সূত্র সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে জানতে ক্যাপ্টেন আজিজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি সারাজীবন বিদেশে কাজ করেছি। দেশের সেবা করার জন্যই আমি এখানে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সে দেশের কিছুটা সেবা করি। কিন্তু বিমানের নিয়োগ নিয়ে যে এতকিছু চলছে সেটা আমি জানতাম না। সেজন্য আমি রিজাইন লেটার পাঠিয়েছি। এই পরিস্থিতি আমার ভালো লাগছে না। জীবনে সম্মান অর্জন করতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু হারাতে সময় লাগে মাত্র এক মিনিট। বিমানে যা হচ্ছে, তা আমার ভালো লাগছে না। আমি এখানে কেন থাকব? তাই আমি রিজাইন লেটার দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘রিজাইন লেটার নিয়ে এখন আলোচনা চলছে বিমানের সঙ্গে। আমি লন্ডন থেকে এসেছি। কিন্তু আমি জানি না এখানে আসলে কী হচ্ছে। আমি সবসময় চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এর পর আমি চিন্তা করলাম আর কয়দিনই বা বাঁচব, দেশের জন্য কিছু করি। একমাত্র এটাই ছিল বাংলাদেশে আসার কারণ। বিমান নতুন নতুন রুট করছে, সেখানে ভালো কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা হলো না। বিমানে যে বেতন সেটা আমার অ্যালাউন্সের চেয়ে লেস। টাকা-পয়সার জন্য আমি এখানে আসিনি।’

বিজ্ঞাপন

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালের ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। তবে বাংলাদেশ বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই তথ্য আমার জানা নেই। এটা নিয়োগ শাখা ভালো বলতে পারবে। আমি আপনার কাছেই প্রথম শুনছি বিষয়টি। তাই এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না।’

এদিকে, বিমানে নিয়োগ পাওয়ার পর টেকনিক্যাল পরীক্ষা, গ্রাউন্ড ডেঞ্জারার্স গুডস, ইন ফ্লাইট সিকিউরিটি, সিআরএম, এসইইপি, এসএমএস এই কোর্সগুলো করানো হয়েছে ক্যাপ্টেন আজিজুল হককে। যেখানে বিমানের প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। ফলে তাকে এখন অব্যাহতি দিলে তার পেছনে খরচ করা টাকার পুরোটাই জলে যাবে।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমান নতুন নতুন রুট চালু করছে। যে রুটগুলোর জন্য নতুন বৈমানিক প্রয়োজন। বর্তমানে যে কয়টি রুট আর উড়োজাহাজ রয়েছে বিমানে তার চেয়ে বৈমানিকের সংখ্যা কম। ফলে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া বৈমানিক আজিজুল হককে অব্যাহতি দেওয়া হলে সেই ঘাটতি আরও বাড়বে।

অন্যদিকে, সূত্র জানায়, সংকট থাকার কারণেই সম্প্রতি ১৪ বৈমানিককে নিয়োগ দেয় বিমান। নিয়োগে প্রথম থেকেই অভিযোগ ওঠে, যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্য এবং বিদেশে ব্যর্থদের নিয়োগ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা। এছাড়া, বৈমানিক সংকট থাকার পরও বোয়িং ৭৮৭ বিমানের ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়ে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বৈমানিক সংকট বাড়ছেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন- শাহ নাসিমুল আওয়াল, মো. হারুনর রশিদ, আবদুল্লাহ মারুফ, ইরফান উল হক, হোসাইন মো. শওকত জাহান, আবু নুর মো. তাহমিদুল ইসলাম, নাসিম ইবনে আহমেদ, ক্যাপ্টেন আজিজুল হক।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ বিমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। যার বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে ইস্যু করা কোনো লাইসেন্স নেই। ক্যাপ্টেন নিয়োগে বাংলাদেশ বিমানের অপারেশন ম্যানুয়েল (অ) এর প্যারা ২.১.৪.৭.৪ এর (ই) এর পাতা ২.৭-তে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে বৈমানিক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে একজন বৈমানিকের প্রথম এবং প্রাথমিক যোগ্যতা হলো- বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের ইস্যুকৃত বৈধ (এটিপিএল- এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স) থাকতে হবে। তবে ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আটজনের মধ্যে সাতজনেরই লাইসেন্স ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। আর ক্যাপ্টেন আজিজুল হকের তো বাংলাদেশি লাইসেন্স-ই নেই। যা বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পরিপন্থী।

সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, ক্যাপ্টেন আজিজুল হকের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৩ নভেম্বর। তিনি বাংলাদেশে এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন যুক্তরাজ্যে। আর সেখানেই ১৯৯৮ সালে আজিজুল হকের বৈমানিক জীবন শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সএয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩২০ বিমানে ফাস্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অতঃপর দোহার-কাতার এয়ারলাইন্সে ফাস্ট অফিসার হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এয়ারবাস এ৩২০ বিমানে কাজ করেন তিনি। এরপর ২০০৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কাতার এয়ারলাইন্সের এ৩২০/এ৩৩০ বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন আজিজুল হক। তিনি চার্টাড বৈমানিক ও ফ্লাইং ইন্সট্রাকটর হিসেবেও কাজ করেছেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালে আজিজুল হক কাতার এয়ারওয়েজের এয়ারবাস৩৮০ বিমানের ক্যাপ্টন ট্রেনিংয়ের সময় অকৃতকার্য হন। পরে একই বছর কাতার এয়ারওয়েজ থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় আজিজুল হককে। সাধারণত কোনো বৈমানিককে বাংলাদেশে বিমান পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নিতে হলে সেই ব্যক্তিতে অবশ্যই সব গ্রাউন্ড সাবজেক্টে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি মেডিকেলেও ফিট থাকতে হবে। কিন্তু বিমানের বোয়িং ৭৭৭ বিমানের মতো উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই বৈমানিক বাংলাদেশি লাইসেন্স নিতে এখন পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের কোনো ধাপই সম্পন্ন করেননি।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন আজিজুল হক। ট্রেনিংয়ে অকৃতকার্য, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং বাংলাদেশে বিমান পরিচালনার কোনো লাইসেন্স না থাকলেও এই ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। অথচ বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগ নীতিমালায় যেকোনো বৈমানিককে অবশ্যই বাংলাদেশি লাইসেন্স থাকতে হবে। একইসঙ্গে মেডিকেলেও উত্তীর্ণও হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানের নিয়োগে ১ নম্বর শর্তের ১ ও ২ অনুচ্ছেদই অনুসরণ করা হয়নি।

সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন