বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু : অদম্য স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন

July 1, 2022 | 5:11 pm

প্রদীপ সাহা

পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। সব বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে গত ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধন করা হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আগামী জুন ২০২৩ থেকে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা। দেড় ঘণ্টার পথ এখন সহজেই পাঁচ-ছয় মিনিটে অতিক্রম করা যাবে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অংশের জন্য খুলে গেল সহজ যোগাযোগের দ্বার। পদ্মা সেতু শুধু একটা স্থাপনা নয়, এটি দেশের আত্মমর্যাদা, সামর্থ্য এবং সক্ষমতার উজ্জ্বল প্রমাণ। মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত এ সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই উন্নতি ঘটাবে না, সহজেই গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হবে। স্বপ্নের এ সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে সংযোগ সড়ক, রেল সংযোগ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার নানা প্রকল্প ও কর্মকান্ড। এ সেতু নির্মাণে সুফল আসবে নানাভাবে এবং তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। স্বাধীনতার ৫১ বছর ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে ওইসব এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তেমনভাবে উন্নতি হয়নি। বর্তমানে পদ্মা সেতু এসব জেলায় সহজেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনো শিল্পের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে, এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতুর ফলে এসব পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো উপকৃত হবে। সেতুর কল্যাণে সেখানে এখন ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আসবে।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে যে, অন্যান্য বড় নদীর ওপরও সেতু নির্মাণ সম্ভব। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার পর তখনই পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূচনা হয়। ২০১০ সালে সেতুর নকশা চূড়ান্ত হয়। এরপর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে এ প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারকিতে পরামর্শক নিয়োগে বিশ্বব্যাংক এতে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঋণচুক্তি বাতিল করে। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেন। এটা ছিল এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সেদিন অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে সংশয় নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। এরপর ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানায় যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালতও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ব্যাপারে তারা কোনো উপযুক্ত প্রমাণ পাননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজ সিদ্ধান্তে অটুট থেকে বিদেশি কোনো সংস্থা থেকে ঋণ না নিয়ে সম্পূর্ণভাবে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সবাইকে আজ দেখিয়ে দিলেন।

আজ পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসের সাক্ষী হয়ে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মা সেতু আমাদের প্রবল আত্মবিশ্বাসের জবাব। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক। পদ্মা সেতু শুধু একটা সেতু নয়Ñএটা বাংলাদেশের অহংকারের নিদর্শন। নতুন বাংলাদেশের একটা শক্তি। আন্তর্জাতিকভাবে এ সেতু আজ বাংলাদেশকে উচ্চ মর্যাদায় স্থান করে দিয়েছে। অনেক প্রতিকূলতা ও বাধা ডিঙিয়ে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক ও দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে দেশের সক্ষমতার উজ্জ্বল প্রতীক। ভয়ঙ্কর পদ্মার বুকে কারিগরি নানা জটিলতা কাটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এ সেতু।

পদ্মা সেতুটি দ্বিতল এবং ইস্পাত ও কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের পথ এবং নিচে অর্থাৎ ইস্পাতের কাঠামোর ভেতর দিয়ে রয়েছে রেলপথ। ভূমিকম্পরোধী মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং দুই পারে সেতুর বাইরে উড়াল পথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। ২২ মিটার চওড়া সেতুর সড়কটি চার লেনের এবং মাঝখানে রয়েছে সড়ক বিভাজক। নদীর পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। ফলে নিচ দিয়ে সহজেই বড় নৌযান চলাচল করতে পারবে। সেতু দিয়ে গ্যাস, ফাইবার অপটিক কেবল এবং টেলিফোনের তার নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ সেতুর মেয়াদ হয় ৬০-৭০ বছর। কিন্তু পদ্মা সেতু এক শ’ বছর হলেও তা আরও দীর্ঘদিন ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে। ৪২টি পিলার এবং ৪১টি স্প্যান বসানো সেতুটি প্রায় ১০ হাজার টন লোড বহন করতে সক্ষম।

বিজ্ঞাপন

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে সারা দেশের জনগণের মধ্যেও। সেতু দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে ৫৫ থেকে ১১০ শতাংশ সময় কম লাগবে। দূরত্ব কমবে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। আগামী ২০২৩ সালে অর্থনীতিতে পরিচালন ব্যয় সাশ্রয় হবে ৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। প্রতি বছর এ সাশ্রয় ৭ থেকে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে ২০৪৪ সালে সাশ্রয় বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। পদ্মা সেতু নির্মাণকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংযুক্তি বিকাশে বাংলাদেশের নেতৃত্বের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, পদ্মা সেতু আমার কাছে সাহসের একটি প্রতীক, সংকল্পের প্রতীক এবং সমৃদ্ধিরও প্রতীক।

আমাজনের পর পদ্মা নদী হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী। ভয়ঙ্কর এ পদ্মা নদীকে নিয়ে কিছুদিন আগেও মানুষ ভীষণভাবে আতঙ্কিত ছিল। সর্বনাশা পদ্মা নদীর গর্ভে কত গ্রামের পর গ্রাম এবং জনপদ ভেসে গেছে তা ইতিহাসই সাক্ষী দেয়। আজ এই প্রমত্তা-ভয়ঙ্করী নদীর ওপর অবিশ্বাস্যভাবেই তৈরি হলো পদ্মা সেতু। মানুষ এখন পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে কংক্রিটের বাঁধানো সেতু দিয়ে সহজেই পাড়ি দিতে পারবে সর্বগ্রাসী রাক্ষসী পদ্মা নদী। এখন আর দুর্যোগের কারণে যাতায়াতে কোনো ভয় থাকবে না, আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে উন্মত্ত নদীর বিপদ সংকেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। ফেরিঘাটে ভোগান্তির কথা ভেবে যারা বিভিন্ন উৎসবে কিংবা যেকোনো সময়ে বাড়িতে যেয়ে প্রিয়জনদের কাছে যাওয়ার স্বপ্নকে মাটিচাপা দিত একসময়, আজ আর তাদের সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে না। কঠিন ভোগান্তি কাটিয়ে এখন অল্প সময়েই তারা পৌঁছতে পারবে স্বপ্নের বাড়িতে, প্রিয়জনের কাছেÑআর থাকবে না কোনো বাধা। এক কথায়, অদম্য স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন এ পদ্মা সেতু আজ পুরো দেশের চিত্র নিমিষেই পাল্টে দিলÑসহজ যোগাযোগের পাশাপাশি অবহেলিত জনপদগুলোর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিল।

লেখক: কলাম লেখক

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন