বিজ্ঞাপন

কোলাহলমুক্ত ফাঁকা ঢাকা

July 14, 2022 | 6:21 pm

প্রদীপ সাহা

রাস্তায় কোনোরকম যানজট নেই, গাড়ির হর্ণের জোরালো কোনো শব্দ নেই। নেই অহেতুক বাড়তি গাড়ির চাপ, গাড়ির ভেতর কোনো হকার কিংবা ভিক্ষুকের উপদ্রব নেই। রাস্তায়-ফুটপাতে গা ঘেঁষে হাঁটা নেই, গাদাগাদি নেই, নেই অধিক মানুষের কোলাহল। গণপরিবহনগুলোতেও নেই বাড়তি কোনো যাত্রীর চাপ। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি পরিবেশ, চমৎকার পথ চলা। এটা আমাদের রাজধানী ঢাকার চিত্র। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না তো! বিশ্বাস না হবারই কথা। বর্তমান ব্যস্ত সময়ে ঢাকা শহরে এমন দৃশ্যের কথা ভাবাটা নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ঢাকা সত্যিই ফাঁকা থেকেছে গত কয়েকদিন। তবে এমন চিত্র সবসময় দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় না। ইদের ছুটির সময়ের কথা বলছি। ইদের ছুটিতে পুরো রাজধানীই থাকে কোলাহলমুক্ত এবং ফাঁকা। অনেক কম সময়েই পৌছানো যায় গন্তব্যে। কোনোরকম ভোগান্তি নেই। পাল্টে যায় চিরচেনা ঢাকার দৃশ্যপট। এ দৃশ্য ঢাকাকে দেয় নতুন প্রাণ, করে তোলে শান্ত ও প্রাণবন্ত।

বিজ্ঞাপন

তবে রাজধানীর এ চিত্রটা সাময়িক। বছরের নির্দিষ্ট দিনে স্বজনদের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে চলে যায় বেশিরভাগ কর্মজীবী মানুষ। আর তাই রাজধানী থেকে সাময়িকভাবে বিরতি নেয় আমাদের চিরচেনা ব্যস্ততা এবং যানজট। সড়কগুলোতে মানুষ কিংবা গাড়ির যাতায়াত থাকে একেবারেই হাতেগোণা। যানজটের কোনো বালাই নেই। সাধারণভাবে যেখানে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে এমন পরিস্থিতিতে অনেক কম সময়েই যাওয়া সম্ভব হয়। ব্যস্ততম সব রাস্তাই থাকে ফাঁকা। ট্রাফিক সিগন্যালেও দেখা যায় না কোনো বিধি-নিষেধ।

গত প্রায় দু’বছর ইদের আনন্দ সেভাবে সবাই উপভোগ করতে পারেনি করোনা মহামারীর কারণে। এবার সংক্রমণ অনেকটা কমে যাওয়ায় আনন্দ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ছাড়া মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। তবে এবারের ঈদে বেশিরভাগ মানুষের রাজধানী ছাড়ার আরও একটি কারণ ছিল- আর তা হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এতদিন ফেরীর ভোগান্তির কথা ভেবে অনেকেই গ্রামের বাড়ি যেতে চাননি। এবার পদ্মা সেতু তাদের সহজে বাড়ি যাওয়ার স্বপ্নকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে; প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছেটাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। কোটি মানুষের বসবাসের শহর রাজধানী ঢাকা তাই কার্যত ফাঁকা হয়ে পড়ে এই ইদের ছুটিতে। চিরচেনা ঢাকা হঠাৎ করেই অচেনা রূপ ধারণ করে।

ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা বর্তমানে একটা স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। দিন যতই যাচ্ছে, ততই যেন যানজট বেড়ে চলেছে। ফলে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত কিংবা কর্মক্ষেত্র যেকোনো জায়গাতে সঠিক বা স্বল্প সময়ে পৌঁছানো সত্যিই অবিশ্বাস্য ও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ঢাকা শহরে এমন কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে যানজট নেই। সব রাস্তার একই চিত্র। এই যানজট যে কত কষ্টের, কত ভোগান্তির- তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না। যারা প্রতিদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করেন, অফিসের কাজে কিংবা প্রয়োজনীয় কাজে বের হন, তারা সহজেই বুঝতে পারেন- যানজটের দুর্ভোগ কত অসহনীয়! রাজধানী ঢাকার প্রতিদিনের চিত্রই হচ্ছে যানজট, কোলাহল, অসংখ্য যানবাহন, অগণিত মানুষের গিজগিজ অবস্থা, গাড়ির হর্ণের শব্দে কানে তালা লাগা, কালো ধোঁয়া ইত্যাদি। কিন্তু ইদের আনন্দে মানুষ রাজধানী ছাড়ার ফলে ঢাকাকে মনে হয় সম্পূর্ণ অচেনা- যেন নতুন এক ঢাকা, শান্তিময় প্রাণের ঢাকা। ব্যস্ততম ঢাকাতে এরকম পরিবেশ পাওয়া বা দেখার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করা যায় না। কিন্তু ইদের ছুটি সেই স্বপ্নটি কিছুদিনের জন্য হলেও সহজে দেখার সুযোগ করে দেয়। একই সময়ে বাসা থেকে বেরিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগেও কর্মস্থলে উপস্থিত থাকা যায়। ফাঁকা রাস্তায় বিভিন্ন সড়কে শুধু বড়রাই নয়, শিশু-কিশোররা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়, খেলাধুলা করে।

বিজ্ঞাপন

ইদের ছুটি শেষ হলেও ঢাকার রাস্তা থাকে অনেকটাই ফাঁকা। দু’টি ইদের বদৌলতে প্রায় এক সপ্তাহ করে এরকম চিত্র আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়। ছুটি কাটিয়ে মানুষ কর্মস্থলে ফেরার পর আবার চিরচেনা ব্যস্ত নগরীতে পরিণত হয় প্রিয় রাজধানী ঢাকা। শুরু হয় আবার সেই যানজটের ভোগান্তি, কানফাটানো হর্ণের শব্দ, গাদাগাদি করে গাড়িতে ওঠা এবং পথ চলা। কিন্তু এই যে মাত্র কয়েকটি দিন আমরা সুন্দর একটি পরিবেশ এবং চিত্র উপভোগ করার সুযোগ পাই, তাতে বারবারই মনে একটি আশা জাগে- এমন যদি হতো আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা; এমন যদি হতো আমাদের দৈনন্দিন কর্মস্থলে যাতায়াত ব্যবস্থা! আমরা যারা কর্মজীবী, যারা কাজের জন্য রাজধানীতে ছুটে আসি যানজটের ভোগান্তি উপেক্ষা করে- প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত যারা অনেকগুলো সময় বৃথা নষ্ট করে যানজটে বসে থাকি, তাদের কাছে রাজধানী ঢাকার এমন দৃশ্য সত্যিই যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। বিশ্ব ব্যাংক ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি তথ্যে জানা যায়, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। কিন্তু এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ গত দেড় দশকে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমে গেছে ঘণ্টায় প্রায় ১৬ কিলোমিটার। হিসাব অনুযায়ী, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতির মূল্য বছরে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছিল। আর এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। হিসাবের তথ্যটি নিঃসন্দেহে ভেবে দেখার বিষয় বৈকি!

ইদের ছুটি কাটানোর পর আবার সবাই ফিরে আসে রাজধানীতে, ফিরে আসে যার যার কর্মস্থলে। শুরু হয় আবার রাস্তায় গাদাগাদি করে চলাফেরা, যানজটের অসহ্য ভোগান্তি, অবাধে চলে সব যানবাহন। যান চলাচল বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই আবার অপেক্ষা করতে হয় ট্রাফিক সিগন্যালে। প্রিয় নগরী আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলেও বেশিরভাগ মানুষই প্রিয় ঢাকাকে মাঝে মাঝে এমন রূপে দেখতে ভালোবাসেন। অনেকেই মনে করেন, এরকম শান্ত-কোলাহলমুক্ত এবং যানজটমুক্ত পরিবেশে শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বস্তি পাওয়া যাবে। আর তাই সঠিক একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়ম করে ব্যস্ততম রাজধানী ঢাকাকে মাঝে মাঝে এমন শান্তিময় পরিবেশে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা এবং যানজটমুক্ত ও শব্দদূষণমুক্ত করা যায় কিনা সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এবং নগর পরিকল্পনাবিদগণ ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন