বিজ্ঞাপন

এখনি কাটছে না গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ

July 25, 2022 | 11:01 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জ্বালানি সংকটে বন্ধ দেশের সব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রেও উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারপরও প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এদিকে, গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামে ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড সার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘাটতির কারণে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে আবাসিকে পর্যায়েও। সরকার আশা করছে, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বিজ্ঞাপন

সরকারের এমন আশাবাদের বিপরীতে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে তেল-গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সামনের দিকে এই সংকট আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নতুন সন্ধান পাওয়া গ্যাসক্ষেত্র থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন শুরু করতে হবে। পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন শুরু করা গেলে কম সময়ের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।

দেশে দুইটি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে গ্যাস সরবরাহ করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), তেল সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২৮টি। আর গ্যাসের মজুত ২৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এসব ক্ষেত্র থেকে থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১৯ দশমিক ১১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

সূত্র মতে, গত ১৩ বছরে নতুন ১৭টি কূপে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সাতটিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে যে গ্যাস আছে তা আগামী ৯-১০ বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে। কেননা, বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি ঘনফুট। আর গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাসের চাহিদা বাড়তে বাড়তে বছরে এক লাখ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছে। সে তুলনায় গ্যাসের বড় কোনো মজুত আবিষ্কার না হওয়ায় নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা এরই মধ্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমছে। যে কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎসটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং বেড়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি’র আমদানি।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সাড়ে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২৩০০ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে কাতার ও ওমান থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চাহিদার বিপরীতে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে। এই চাহিদা মেটানো হতো আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে আমদানি করে। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম চড়া হওয়ায় গত দুই মাস ধরে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সারাদেশে সপ্তাহে একদিন ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের পাম্পগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অফিসের সময়সূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রি নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা তিন উপায়ে গ্যাস সরবরাহ করে থাকি। নিজস্ব উৎস থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি, আর খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করি। এই তিনটিকে ব্যালেন্স করে এতদিন চলেছি। গত বছরের শুরু থেকেও আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে খোলাবাজারে এলএনজির দাম দ্বিগুণ-তিন গুণ বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজার থেকে যেটুকু আমদানি করা হয়, সেটি আর আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যে পরিমাণে দাম বেড়েছে, সে পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা আপাতত জ্বালানি সাশ্রয় করার উদ্যোগ নিয়েছি।

দেশের গ্যাস মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প কারখানা এবং বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় দেড় হাজার টেক্সটাইল শিল্প কারখানা রয়েছে, যা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। দিন দিন তৈরি পোশাকের রফতানি বাড়তে থাকায় এই খাতে গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়বে। তবে বর্তমানে যে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে তা বেদি দিন থাকলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগের উৎসাহ কমে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সরকার বলছে, এই পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না। সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কারণ শীত মৌসুম চলে আসবে, বিদ্যুতের চাহিদাও কমে আসবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বিপরীত মত দিয়ে বলছেন, এই সংকটের শেষ হচ্ছে না শিগগিরিই।

এ প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস ও অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এখন এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে অনেকটা আমদানি নির্ভর হয়ে গেছি। আমরা আগে থেকেই বলেছি যে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম উঠবে-নামবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু দাম বাড়লে সেটি কতটুকু পর্যন্ত আমরা বহন করবে পারব, সেটি বড় প্রশ্ন। এখন যেমন বেশি দামের কারণে খোলাবাজারের গ্যাস আমরা নিতে পারছি না।

বদরুল ইমাম বলেন, আমাদের দেশে প্রতি তিনটি কূপ খনন করলে একটিতে গ্যাস পাওয়া যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার গড়ে প্রতি পাঁচটিতে একটি। এখন কম সময়ের মধ্যে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করা সম্ভব না, এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় পরিত্যক্ত যে কূপগুলো রয়েছে, সেগুলোতে অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। পাশাপাশি আবিষ্কৃত হয়ে রয়েছে, এমন ক্ষেত্রগুলো থেকে দ্রুত উৎপাদন শুরু করা প্রয়োজন।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমাদের পুরো শিল্প অবকাঠামো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তাই হঠাৎ করে গ্যাস সরবরাহে সংকট দেখা দিলে তা অর্থনীতে বড় ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তাই এখন থেকে নতুন নতুন অনুসন্ধান শুরু করলে হয়তো সেটি কয়েক বছরের মধ্যে কাজে দেবে।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ বছরে কেবল ১৭টি কূপে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ার এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) খনন করেছে ১৪টি কূপ, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) খনন করেছে দুইটি কূপ এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিএফসিএল) খনন করেছে একটি কূপ। এর মধ্যে সাতটিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য মজুত পাওয়া গেছে।

এসব গ্যাসক্ষেত্র প্রসঙ্গে বদরুল ইমাম বলেন, ২০১৭ সালে জানা গেল— আমাদের গ্যাসের পরিধি কমে আসছে, সরকার যখন চড়া দামে আমদানিতে যাচ্ছে। তখনই আমরা গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান বাড়াতে জোর দিতে বলেছি বারবার। কিন্তু তাতে কোনো গতি আসেনি। জ্বালানি আমদানির সঙ্গে সমান্তরালভাবে দেশের ভেতরে সরবরাহ বাড়াতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

এদিকে জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি সংকট মোকাবিলায় সরকারও উপায় খুঁজছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি পুরনো গ্যাসক্ষেত্র ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান গ্যাস সংকট চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এখন আমরা পুরনো ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে অনুসন্ধান চালানোর পাশাপাশি আরও পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে গভীর খননকাজের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আপৎকালীন বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারকে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নিতে হবে। কারণ বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবং জ্বালানি আমদানি করার সামর্থ্য সরকারের না থাকলে নিজেদেরই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সে কারণে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই। সেটি না পারলে ফের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফিরতে হতে পারে কয়লায়।

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন