বিজ্ঞাপন

জ্বালানির জ্বালা: কাঁচামরিচেও ডলার-আইএমএফ!

August 7, 2022 | 12:59 pm

মোস্তফা কামাল

একরাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর আরেক রাতে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা। দূরপাল্লায় প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা এবং মহানগরে ৩৫ পয়সা বাস ভাড়া বাড়ালো ‘বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি’ (বিআরটিএ)। শনিবার রাতে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সাথে বৈঠকে এই বাড়তি ভাড়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিআরটিএর ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। শনিবার সকাল থেকেই পরিহনের সংকট তৈরি করে বাড়তি ভাড়া হাতানো শুরু হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

দু’ঘণ্টা সময় বেধে দিয়ে সবধরণের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা বেড়েছে। ডিজেল, পেট্রোল কেরোসিন ও অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে রাত ১২টা থেকে নতুন দাম কার্যকর শুরু হয়। জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর পরই রাজধানীর অধিকাংশ পেট্টোল পাম্প তেল দেয়া বন্ধ হয়ে যায় অদৃশ্য রিমোটকন্ট্রোলে।

তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকারপক্ষের অনেক যুক্তি। ভর্তুকি কমানো, অর্থ পাচার বন্ধ সর্বোপরি বিশ্বাজারের যুক্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। আইএমএফের ঋন চাওয়ার জন্য দাম বাড়াতে হয়েছে-এমন অজুহাতও রয়েছে। অর্থনীতি কম বোঝা মানুষও বোঝেন এগুলো যুক্তির নামে কুযুক্তি। আইএমএফের ঋন বহুদেশই নেয়। তারা কি অজুহাত দেয়? বিশ্ব বাজারে কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে তেলের দাম কমছে। বহু দেশেই দাম কমানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দুই বাক্যের বিবৃতি কচিকাঁচার আসরের শিশুর মতো ঘোষণা আবৃতির মধ্যে মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন শেষে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস।

বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, বাড়ানো হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, অস্বাভাবিক হচ্ছে দাম বাড়ানোর সময় ও রকমফের নিয়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের পড়তি দামের সময় বাংলাদেশে দাম চড়িয়ে দেয়া নিয়ে গোঁজামিল মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। সরকারের জন্য কি জরুরি ছিল? অথবা এর বিকল্প ছিল না? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অয়েল প্রাইস ডট কম বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলই বিক্রি হচ্ছে ব্যারেল প্রতি ৯৬ মার্কিন ডলারের নিচে। অন্যদিকে, অপরিশোধিত তেলের মিশ্রণ বা ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট বিক্রি হচ্ছে ব্যারেল প্রতি ৮৮ দশমিক চার শূন্য ডলারে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের মতে, করোনা সংক্রমণ বাড়ায় বিভিন্ন দেশ আবারও লকডাউনে যাওয়ায় কমেছে তেলের চাহিদা। যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হ্রাস পাওয়ায় তেলের চাহিদা কমেছে রাশিয়া ও চীনে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর আহ্বানে সরবরাহ বাড়িয়েছে সৌদি আরব ও লিবিয়া। এ পরিস্থিতিতে গত এপ্রিলের পর এবারই সবচে’ দ্রুতগতিতে কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ ক্রেতা দেশগুলোয় স্বস্তি ফিরবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের। এ বছরের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলারের বেশি ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এক পর্যায়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় একশ’ ৩৯ ডলারে। চলমান পরিস্থিতিতে ডিজেলের দাম কমায় বৃহস্পতিবার বাসভাড়া ১১ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে শুক্রবার পেট্রোল ও ডিজেল দুটোরই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ভারত। সরকারের দিক থেকে কেবল ভারতের উদাহরণ সামনে আনা হচ্ছে।

এর আগে, বিশ্ববাজারের কথা বলে মানুষকে কষ্ট দিয়ে লেজেগোবরে করে বাড়ানো হয়েছে ভোজ্যতেলের দাম। ফায়দা লুটেছে মজুতদার- মুনাফাখোররা। আবার কিঞ্চিত কমানোও হয়েছে মুনাফাখোরদের আনুপাতিক সুযোগ বহাল রেখে। ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা। ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছে। এবার আবারো জ্বালানি তেলের জ্বালা। জ্বালানি তেলের সঙ্গে সম্পর্ক আরো অনেক কিছুর। পরিবহনভাড়া গেছে। মূল ধাক্কা পড়বে কৃষি উৎপাদনে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে সারের দামও বেড়ে গেছে। কৃষি খরচও বেড়ে গেছে। ফসল উৎপাদনের আগে ও পরে ডিজেলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। এখন এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষিতে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, শঙ্কার বিষয়। কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তার বড়াইটি এখন কড়াইতে ওঠার পথে হাঁটছে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদনও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। রফতানি ব্যয় বাড়বে। জীবনযাপনে আরও বিপর্যয় নেমে আসার যাবতীয় লক্ষণ বিদ্যমান। বাজারে এমনিতেই মূল্যস্ফীতি। তা আরো বৃদ্ধির অবশিষ্ট কারণ নিশ্চিত হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে। অপেক্ষমান তালিকায় এখন বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানোর। সেই বার্তা দিয়েই রাখা হয়েছে।

আইলা বা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিও পুষিয়ে নিয়ে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু নিত্যপণ্যের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি কোথায় নেবে মানুষকে? সপ্তাহ ব্যবধানে ১৬০ টাকার কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। দাম বেড়েছে অন্যান্য সবজিরও। আরেক দফা দাম বেড়েছে মসলাসহ মুদিমালের দাম। সেখানেও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত বিক্রেতাদের। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই তো চলছেই। করোনা মহামারির অজুহাত এখনো বন্ধ হয়নি। দুষ্টু প্রকৃতির দোকানদারদের লাউ-কুমড়ার বাড়তি দাম নিয়ে ডলারের দাম বৃদ্ধি, শাকের দামের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা বা পুঁটি মাছের দামের জন্য আইএমএফকে দায়ী করার এই রোগ সমাজের নানা মহলকেই আক্রান্ত করে বসেছে। পাওনা টাকা চাইতে গেলে সামনে নিয়ে আনা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির অজুহাত। কেবল সরকারের ভেতরে নয়, অসাধু মনোবৃত্তির চর্চা সমাজের স্তরে-স্তরে ঢুকে পড়া বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সরকার বলছে, নিরুপায় হয়ে জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণ নিয়েও কথামালার শেষ নেই। যুক্তি-অজুহাতের পাশাপাশি যার মন যা চায় বলে দেয়ার সংস্কৃতি কেবল ডালপালা ছড়াচ্ছে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, এলএনজি, এলপিজি- সব ক্ষেত্রে সাপ্লাই পর্যায়ে উৎস থেকে শুরু করে একেবারে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত যত রকমের অপচয়-লুণ্ঠন রয়েছে তার সবই হচ্ছে। গোটা দেশ তথা জাতির জন্যই এটি অশনি সংকেত।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন