বিজ্ঞাপন

‘বারমুডা ট্রায়েঙ্গেল’র সমাপ্তি

August 20, 2022 | 11:20 pm

সাহাবার সাগর, নিউজরুম এডিটর

কিছুদিন আগেই উয়েফা সুপার কাপের শিরোপা ঘরে তুলল রিয়াল মাদ্রিদ। আর এই শিরোপা জয়ের পর রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলোত্তি বললেন, আমি ক্রুস, ক্যাসেমিরো আর মদ্রিচকে (কেসিএম) নিয়ে গড়া মিডফিল্ডকে বারমুডা ট্রায়েঙ্গেল বলি। কারণ এখানে যখন বল যায় তখন বল হারিয়ে যায়।’ আধুনিক ফুটবলের ইতিহাসে সেরা মিডফিল্ড ত্রয়ী বললে ভুল বলা হবে না। কেননে এই কেসিএম টানা তিনটিসহ মোট পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। তবে এবার সমাপ্তি ঘটল এই বারমুডা ট্রায়েঙ্গেলের। রিয়াল মাদ্রিদে দীর্ঘ ৯ বছর কাটানোর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লেখালেন কার্লোস হেনরিক ক্যাসেমিরো।

বিজ্ঞাপন

তবে ক্যাসেমিরোর ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরুটা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে নয়। সে সময় তিনি ছিলেন ফরোয়ার্ড। সাঁও পাওলোর একাডেমিতে ট্রায়ালের সময় তিনি ফরোয়ার্ড থেকে বনে যান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। সে গল্প ক্যাসেমিরো শুনিয়েছেন এভাবে, ‘আমি যখন সাঁও পাওলোতে ট্রায়ালে গিয়েছিলাম তখন আমি একজন ফরোয়ার্ড ছিলাম। আমি বেশ শক্তিশালী ছিলাম, সেই বয়সে আমি অন্যদের তুলনায় লম্বা খেলোয়াড় ছিলাম এবং আমি হেড দিয়ে অনেক গোল করতাম।’

‘আমার বয়স প্রায় ১২ বা ১৩ বছর, ট্রায়ালে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে ছিল প্রায় ৩০০ জন খেলোয়াড়। এত খেলোয়াড়ের মধ্যে ক্লাব মাত্র ৫০ জনকে বেছে নেবে। আমার খুব ভাল করে মনে আছে যে কোচ যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে গোলরক্ষক কারা, তখন তিনজন তাদের হাত তুলেছিল। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কয়জন ফরোয়ার্ড এবং ৪০ বা তারও বেশি বাচ্চারা তাদের হাত তুলেছে এবং আমি মনে মনে ভাবলাম, অনেক প্রতিযোগিতা তাই আমি স্ট্রাইকার হবো না। একই ঘটনা ঘটেছিল যখন তারা মিডফিল্ডারদের জিজ্ঞাসা করেছিল এবং তাই আমি একই করেছে তারপর কোচ জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো কি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আছে? তখন ৭/৮ জন হাত তুলেছিল তখন আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, আমি একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।’

বিজ্ঞাপন

‘আমি ট্রায়ালের সময় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম এবং কোচ আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে বলেছিলেন তুমি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নও, তুমি ফরোয়ার্ড হিসেবে এখানে এসেছে। কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলেছিলাম যে আমি ডিফেন্সিভ মিড হবো এবং সেখান থেকেই সবকিছু শুরু।’

এর কয়েক বছর পর ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সাঁও পাওলো থেকে রিয়াল মাদ্রিদে ধারে নাম লেখান ক্যাসেমিরো। সে সময় রিয়াল মাদ্রিদ কোচ হোসে মরিনহো জানতেন অখ্যাত কাসেমিরো একদিন বিশ্বের সেরা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হবে। ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ক্যাসেমিরো বলেছিলেন, ‘আমার রিয়াল মাদ্রিদে অভিষেকের দিনে, মরিনহো আমাকে তার অফিসে ডেকেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ক্যাসে তুমি পরের ম্যাচের একাদশে থাকবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমি শুরুর একাদশে থাকব? হোসে বললেন, হ্যাঁ তুমি একজন ভালো খেলোয়াড়। এখন গিয়ে বিশ্রাম নাও দেখো তুমি যখন খেলবে তখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু তোমাকে ভালোবাসবে। সে বলেছিল আমি তোমাকে চিনি, তুমি ভালো, তুমি বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডার হতে যাচ্ছো। হোসে আমাকে এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। তিনি আমাকে যে আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য ছিল। ‘আমার মনে আছে হোটেল রুম থেকে বের হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।’

বিজ্ঞাপন

এরপর ২০১৩/১৪ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদে কাটান এই ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। যদিও মূল একাদশের খেলোয়াড় তখনও হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সেই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন তিনি। পরের মৌসুমে রিয়াল থেকে ধারে এফসি পোর্তোতে নাম লেখান তিনি। সেখানে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটান ক্যাসেমিরো। এক বছরের ধার শেষ করে ২০১৫/১৬ মৌসুমে আবারও রিয়ালে ফেরেন ক্যাসেমিরো।

২০১৫/১৬ মৌসুমের প্রথম ভাগটা দুঃস্বপ্নের মতো কাটে রিয়াল মাদ্রিদ এবং ক্যাসেমিরোর। সে সময়কার কোচ রাফায়েল বেনিতেজের অধীনে রিয়াল মাদ্রিদের ছিল বেহাল দশা। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রাফা বেনিতেজ বরখাস্ত হলে রিয়ালের ডাগ আউটের দায়িত্ব ওঠে কিংবদন্তি জিনেদিন জিদানের কাঁধে। জিদান দায়িত্ব নিয়েই বদলে দেন ইতিহাস। ক্রুস এবং মদ্রিচের সঙ্গে মধ্যমাঠে যোগ করেন ক্যাসেমিরোকে। মধ্যমাঠে ক্রুসের নিয়ন্ত্রণ আর মদ্রিচের সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হলো ক্যাসেমিরোর রক্ষণশক্তি। রিয়ালের মধ্যমাঠে এলো স্থিতিশীলতা।

এরপর টানা তিন মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ জিতল চ্যাম্পিয়নস লিগ। আধুনিক ফুটবল ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ধরে রাখলো আর তারপর জিতল আরও একটি। প্রায় ১১শ দিন ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মুকুট ধরে রাখে রিয়াল। এরপর তিন মৌসুম বিরতির পর ২০২১/২২ মৌসুমে আবারও রিয়ালের মুকুটে যুক্ত হলো আরও একটি চ্যাম্পিয়নস লিগের পালক। যার পেছনে অন্যতম কারিগর হিসেবে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্সিভ এই মিডফিল্ডার কার্লোস হেনরিক ক্যাসেমিরো। তবে সব সাম্রাজেরই পতন এক সময় ঘটে। রিয়ালের ঐতিহাসিক মধ্যমাঠ কেএমসি’রও শেষটা এলো।

বিজ্ঞাপন

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের করা লোভনীয় এক প্রস্তাবে সাড়া দিলেন ক্যাসেমিরো। ৩০ বছর বয়সী এই ফুটবলারের জন্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে গুনতে হচ্ছে ৭২ মিলিয়ন ইউরো (৬০ মিলিয়ন পাউন্ড) এবং সেই সঙ্গে বোনাস হিসেবে ১২ মিলিয়ন ইউরো (১০ মিলিয়ন পাউন্ড)। আর সপ্তাহে ৩ লাখ ৫০ হাজার ইউরো বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয় ক্যাসেমিরোকে। যেটা বাৎসরিক হিসাবে আসে প্রায় ১৮ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি। যেখানে রিয়াল মাদ্রিদে ক্যাসেমিরোর বেতন ছিল বাৎসরিক মাত্র সাড়ে দশ মিলিয়ন ইউরো। অর্থাৎ রিয়ালের থেকে প্রায় ৮ মিলিয়ন ইউরো বেশি বেতনের প্রস্তাব পায় ক্যাসেমিরো। আর এতেই নতুন এক চ্যালেঞ্জের ভাবনায় ইউনাইটেডের প্রস্তাবে সাড়া দেন ক্লাব ফুটবলে সর্বজয়ী এই মিডফিল্ডার। রিয়াল মাদ্রিদও ক্যাসেমিরোর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে ইউনাইটেডের প্রস্তাব গ্রহণ করে।

ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে ২০১৩ সালে রিয়ালে যোগ দেন কাসেমিরো। সময়ের সঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন হয়ে ওঠেন তিনি। ক্লাবের অনেক সাফল্যের সাক্ষী এই মিডফিল্ডার। জিতেছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, তিনটি লা লিগা। রিয়ালের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২২২ ম্যাচ খেলে ২৪ গোল করেছেন কাসেমিরো।

জানা গেছে ইউনাইটেডের সঙ্গে এই চুক্তিতে চার বছর ওল্ড ট্রাফোর্ডে থাকবেন ক্যাসেমিরো আর এক বছর চুক্তি বৃদ্ধিও করতে পারবেন তিনি। সেখানে ক্যাসেমিরো প্রায় ১৮ মিলিয়নেরও বেশি বেতন পাবেন বছরে। যা রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলার টিকিট কাটতে পারলেই বাড়তে পারে তার বেতন।

কেএমসি’র মতো এমন সাফল্য ক্লাব ফুটবলে এনে দিতে পারেনি আর কোনো মিডফিল্ড ত্রয়ী। তবে সাফল্যের গল্প বলতে গেলে বার্সেলোনার জাভি, ইনিয়েস্তা এবং বুস্কেটসকে নিয়ে গড়া মধ্যমাঠকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না কোনোভাবেই। বার্সেলোনার স্বর্ণযুগের সূত্রপাত এই ত্রয়ীকে ঘিরেই। মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে এই ত্রয়ী জিতেছে দুটি ট্রেবল আর সব মিলিয়ে তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ আর বেশ কয়েকটি লা লিগা এবং কোপা দেল রেও। তবে ক্লাব পর্যায়ের সর্বোচ্চ সাফল্য চ্যাম্পিয়নস লিগের হিসাব টানলে রিয়াল মাদ্রিদের এই কেএমসি নিজেদের অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তারা প্রধান একাদশে থেকে জিতেছে মোট চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ যার মধ্যে তিনটিই একটানা। আর সব মিলিয়ে এই মিডফিল্ড ত্রয়ীর চ্যাম্পিয়নস লিগের সংখ্যা মোট পাঁচটি।

তবে এবার বারমুডা ট্রায়েঙ্গেল ভাঙল। ৩৬ বছরের মদ্রিচ, ৩৩ বছরের ক্রুসের নয়, সবার আগে রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়লেন ৩০ বছর বয়সী ক্যাসেমিরো। তার বিদায়ে রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তদের সঙ্গে মন খারাপের অশ্রু ঝরাচ্ছেন। যে ক্রুস আর মদ্রিচের সঙ্গে মিলে অভেদ্য এক মধ্যমাঠ তৈরি করেছিলেন ক্যাসেমিরো সেই দুইজন মন খারাপের মধ্য দিয়েই বিদায় জানিয়েছেন দীর্ঘদিনের এই সঙ্গীকে।

ক্যাসেমিরোর জন্য বিদায়ী বার্তায় মদ্রিচ লেখেন, ‘প্রিয় ক্যাসে, আমার এখনো মনে আছে যেদিন তোমার অভিষেক ঘটে। তুমি কতটা ভয়ে ছিলে আর আমি বলেছিলাম শান্ত হও বন্ধু। আর দেখো এখন সেটা কেমন হলো। আমরা কি কি অর্জন করলাম। তুমি রিয়াল মাদ্রিদের এবং আমাদের জন্য একজন প্রকৃত নেতা ছিলে। আমরা তোমাকে সবসময় মনে রাখবো। তোমাকে অনেক মিস করবো আমরা। কিন্তু এটাই একজন পেশাদার এবং তোমার মতো একজন মানুষ অর্জন করে নিয়েছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ এবং ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা।’

টনি ক্রুস লিখেছেন, ‘আমি তোমাকে অনেক মিস করবো। তোমার মতো এমন পেশাদার এবং একজন যোদ্ধাকে আমি মিস করবো। কিন্তু এর থেকেও বেশি মিস করবো তোমার মতো একজন ভালো মানুষকে। আমরা এক সঙ্গে ইতিহাস গড়েছি এবং আমাদের এই মধ্যমাঠ কিংবদন্তি এক ত্রয়ী। এখন আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেল কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে আজীবন এটা আমি তোমাকে প্রতিজ্ঞা করছি। আমি তোমাকে শুভ কামনা জানাচ্ছি, শীঘ্রই দেখা হবে।’

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ কয়েক মৌসুম ধরে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের অভাবে ভুগছিল। রক্ষণের দুর্বলতাগুলোকে কোনোভাবেই ঠিক করতে পারছিল না রেড ডেভিলরা। একের পর এক বাজে পারফরম্যান্সে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল ক্লাবটি। ২০২২/২৩ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচের দুটিতেই হেরেছে তারা। এরপরেই মধ্যমাঠের এই দুর্বলতা দূর করতে রিয়াল থেকে সদ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী এই মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়াল তারা। তবে কি এবার সব সমস্যা দূর হবে ইউনাইটেডের মধ্যমাঠের?

তর্কসাপেক্ষে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা দুই মিডফিল্ডার টনি ক্রুস এবং লুকা মদ্রিচের সঙ্গে খেলেছেন ক্যাসেমিরো। তবে এবার থেকে তাদের আর পাশে পাবেন না তিনি। এই দুই মিডফিল্ডারকে ছাড়া ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ক্যাসেমিরো কেমন পারফর্ম করেন সেটার দিকেও নজর থাকবে সকলের।

সারাবাংলা/এসএস

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন