বিজ্ঞাপন

ছন্দ হারিয়েছে বর্ষা, চোখ রাঙাচ্ছে তাপদাহ

August 24, 2022 | 10:05 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥’

বিজ্ঞাপন

আষাঢ়-শ্রাবণ তথা বর্ষাকালকে এভাবেই সাহিত্যে, কাব্যে তুলে ধরেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু রবীন্দ্রসাহিত্যেই নয়, বর্ষাকাল নিয়ে এমন অনুভূতি যুগে যুগে স্থান পেয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা ও গল্পে। তবে বর্ষার সেই ছন্দ আর নেই। নেই মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি। এখন আর আষাঢ়-শ্রাবণ মেনে বর্ষা আসে না। দিনে দিনে তার চরিত্র-রূপ-বৈশিষ্ট সবই বদলাতে শুরু করেছে।

আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্ষা কমে গিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। বর্ষাকালের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থানের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তাপদাহ। আবহাওয়াবিদদের মতে, ব্যাপক দূষণের কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে তাপদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বর্ষায় বৃষ্টির দেখা মিলছে না।

বর্ষায় কমেছে বৃষ্টি

বিজ্ঞাপন

বাংলা বর্ষপুঞ্জিতে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা ঋতু। আর ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে জুন-জুলাইকে ধরা হয় বর্ষাকাল। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার জুনে দেশের আট বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার ৯০৮ মিলিমিটার। কিন্তু হয়েছে ১৮ হাজার ২২৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার। জুনে রাজধানী ঢাকায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ২ হাজার ১৩৮ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১ হাজার ৪৭৬ দশমিক ৫ মিলিমিটার। এই বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ।

এছাড়া চট্টগ্রামে ৭ হাজার ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও হয়েছে ৬ হাজার ৭৬৭ মিলিমিটার। যেখানে ঘাটতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। রাজশাহীতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ১ হাজার ৫২৫ মিলিমিটার। সেখানে হয়েছে ৭৯০ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ কম। খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৭৭৬ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা থাকলেও হয়েছে ৭৮৪ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ কম। বরিশালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ১ হাজার ৯৩১ মিলিমিটার প্রত্যাশার বিপরীতে হয়েছে ১ হাজার ৭৪ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ কম।

এদিকে সিলেটে ১ হাজার ২৬৮ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভবনার বিপরীতে হয়েছে ২ হাজার ৫২ মিলিমিটার। অর্থাৎ এখানে বাড়তি বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ। রংপুরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ হাজার ৩৩৬ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ৩ হাজার ৯২৭ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৮ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। সার্বিক হিসাব অনুযায়ী জুন মাসে গড়ে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, জুলাই মাসে এই ঘাটতি ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তথ্যানুযায়ী, জুলাই মাসে ঢাকা বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ২ হাজার ২১০ মিলিমিটার হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৮৭৪ মিলিমিটার। এই বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ছিল ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৫৪ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রত্যাশা ছিল, সেখানে হয়েছে ৪০৭ মিলিমিটার। এই বিভাগে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ। চট্টগ্রামে জুলাইয়ে স্বাভাবিকভাবে ৮ হাজার ৬৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৭৮১ মিলিমিটার। যেখানে ঘাটতি ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ। সিলেটে ১ হাজার ১৫৯ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার বিপরীতে হয়েছে ১ হাজার ৬২ মিলিমিটার। অর্থাৎ এখানে ঘাটতি রয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

এছাড়া রাজশাহীতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০৮ মিলিমিটার, হয়েছে ৬৯০ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ কম। জুলাইয়ে রংপুরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রত্যাশা ছিল ২ হাজার ৫৬৩ মিলিমিটার। কিন্তু হয়েছে ১ হাজার ৭৯৩ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ দশমিক ১ শতাংশ কম। খুলনা বিভাগে ২ হাজার ৩৭ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে হয়েছে ৭২০ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ কম। বরিশালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত প্রত্যাশা করা হয়েছিল ২ হাজার ৭৫ মিলিমিটার। কিন্তু হয়েছে ৭৩২ মিলিমিটার, যেখানে ঘাটতি ৬৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার। সর্বশেষ চলতি ২২ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঘাটতি ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ।

বর্ষাকাল জুড়েই তাপদাহ

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিভাগে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুনে সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কিছুটা বেশি হলেও বলতে গেলে আষাঢ়-শ্রাবণের প্রায় পুরোটা কেটেছে কাঠফাঁটা রোদে। ওই সময় তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বর্ষা শেষ করে শরতেও তাপদাহে পুড়ছে দেশ। সামান্য বৃষ্টিপাত হলেও তাতে গরম কমেনি। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, গত কয়েক বছর ধরেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। এবার কমছে সবচেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন

যে কারণে কমেছে বৃষ্টিপাত

বর্ষাকালে কম বৃষ্টিপাতের জন্য আবহাওয়াবিদরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দায়ী করছেন। আবহাওয়া অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ছানাউল হক মন্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম বৃষ্টিপাত হলেও জুলাইয়ে অর্ধেকেরও বেশি ঘাটতি দেখা গেছে। আবার চলতি আগস্টের ২২ তারিখ পর্যন্ত প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত থেকে ঘাটতির পরিমাণ ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ।

তিনি বলেন, ‘এখন আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এক দেশে প্রচণ্ড তাপদাহ, আরেক দেশে বন্যা, আবার কোথাও শীত। আবার বাংলাদেশে বর্ষা কমেছে।’ এসব বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব বলে মনে করছেন এই আবহাওয়াবিদ।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের মতে, পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেনি। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। আবার কোথাও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘মৌসুমি বায়ু এখন বঙ্গোপসাগরের চেয়ে আরব সাগরের ওপর বেশি সক্রিয়। তাই ওদিকে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।’

বৃষ্টিপাত কম-বেশি হওয়ার ধকলে কেবল বাংলাদেশই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোও ধুকছে; বিশেষ করে ভারত। মৌসুমি বায়ু আগের মতো সক্রিয় না থাকায় দেশের রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা বিভাগে এ বছর স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর মনে করছে, এবার বর্ষাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টিপাত কম হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ছানাউল হক মন্ডল বলেন, ‘এবার যতটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে তার পুরোটাই দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে। আর সবচেয়ে কম হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে। বৃষ্টি কম হওয়ার প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। এই আবহাওয়াবিদের মতে, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আগস্ট জুড়ে থাকতে পারে।’

তবে আবহাওয়া পূর্বাভাসে চলতি আগস্টে বড়ধরনের কোনো ঝড়-বৃষ্টি বা বন্যার আভাস নেই। লঘুচাপ, নিম্নচাপ না থাকলেও সামনের কয়েকদিন খরতাপ মাথায় নিয়েই চলতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে না পারলে প্রকৃতির সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন