বিজ্ঞাপন

আরও খারাপের দিকে বেঁচে থাকা ১২ শতাংশ শ্রমিক

April 24, 2018 | 6:59 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মাথার সিঁথির মত মেঠোপথ ধরে সাভার রাজাশন আমতলা মহল্লার দিকের রাস্তাটা। যেতে যেতে অটোরিকশা গিয়ে থামে মহল্লার শেষ মাথায়। পাশের এক মিষ্টির দোকানে বিক্রেতাকে নিলুফারের বাড়ি কোথায় জানতে চাইতেই অটোরিকশা চালক বলেন, রানা প্লাজার পঙ্গু নিলুফা? আমিই চিনি-চলেন নিয়া যাই।

অটোরিকশা চালক এ প্রতিবেদককে নিয়ে যান নিলুফার বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনে বেশ বড় একটি দোকান, কিন্তু ভেতরে একটি মালামালও নেই। ভেতরের তাকগুলো শূন্য পড়ে রয়েছে। কেবল চা আর পান নিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতা।

নিলুফার বেগমের খোঁজ করতেই বিক্রেতা জানান, নিলুফারের শরীরটা ভালো না, কথা বলতে পারবে কীনা জানি না বলে ভেতরে চলে গেলেন। কিছুসময় বাদেই ফিরে বলেন, আপনি ভেতরে যান, কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

বড় একটি চৌকি, টেবিল আর একটি কাঠের আলমারি দিয়ে সাজানো ছোট একটি ঘর। সেই চৌকিতে বসে আছেন নিলুফার। বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা আর বলতে চাই না। শরীর এমনিতেই খারাপ আর সেদিনের ঘটনা বলতে গেলে শরীরটা আরও খারাপ হয়, মাথার ভেতরে গণ্ডগোল শুরু হয়।’

নিলুফার একথা বলেন ঠিকই, কিন্তু চুপ করে থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘মৃত মানুষকে কবরে নামালেও সেখানে একটু জায়গা থাকে। কিন্তু আমি সেদিন যেভাবে বিমের নিচে পড়ে ছিলাম তাতে করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো জায়গাও ছিল না, ডান পা ভেঙে বাঁকা হয়ে ছিল। বিম আর ছাদের চাপায় পড়ে ছিলাম সাড়ে নয় ঘণ্টার মতো।

বিজ্ঞাপন

পরে কয়েক হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা করলেও চিকিৎসকরা তার সঠিক চিকিৎসা করতে পারেননি বলে অভিযোগ তার।

নিলুফার বলেন, ‘পা তো ভাঙছেই। কোমরেও চাপ খাইছিলাম, তাতে করে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিছে। এখন পায়ের যে অবস্থা তাতে করে মনে হয়, তখন পা টা কেটে ফেললেই ভালো হতো। এখন আর পায়ে কোনো সমস্যা থাকত না। আর পা কাটা মানুষ হিসেবে টাকাই পাইতাম বেশি।’

দুর্ঘটনার পর পায়ের চিকিৎসায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচের কথা বলে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের আশ্বাস দিলেও সেখানে প্রথমে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এরপর বারবার পায়ের ইনফেকশনে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখের মত।

নিলুফার বলেন, দুর্ঘটনার পর ব্র্যাক থেকে ৭৬ হাজার দেওয়া টাকায় ঘরের সামনের দোকানটি করেছিলেন, কিন্তু তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে শূন্য হয়েছে দোকানের সবকিছু।

বিজ্ঞাপন

বরং দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার লোন রয়েছে। এখনও প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়, টাকার জন্য ওষুধ খেতে পারেন না অনেক সময়, তখন শরীর আরও খারাপ হয়। একই কথা বলেন, শিউলি বেগমও। বর্তমানে সাভারের আড়াপাড়া জব্বারের বাড়িতে ভাড়া থাকেন শিউলি ও তার স্বামী গোলাম রাব্বানী। দুর্ঘটনায় শিউলির কোমড়ের হাড় ভেঙ্গেছে। সিএমএইচে চিকিৎসার পর গ্রামের বাড়ি চলে গেলেও জীবিকার তাগিদে আবার ঢাকায় ফিরতে হয়েছে তাদের। দিনমজুর স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না, কিন্তু অসুস্থতা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, একটানা দশমিনিট বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না শিউলি। দিনকে দিন তার শারীরিক অবস্থা কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

কেবল নিলুফার বা শিউলিই নয়, একই কথা বলেন দুর্ঘটনার শিকার উজ্জ্বল দাশ, মাহমুদুল হাসান হৃদয়সহ অন্য ক্ষতিগ্রস্তরাও। তারা জানালেন, যতই দিন যাচ্ছে তাদের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, টাকার অভাবে চিকিৎসাও করতে পারছেন না তারা। এদিকে, অ্যাকশনএইড জানিয়েছে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২২ শতাংশ শ্রমিক এখনও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। দুর্ঘটনার শিকার জীবিত ২০০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে এই গবেষণা করে অ্যাকশনএইড।

শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী এই ক্ষতি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা প্রথমদিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দ্রুত কিছু টাকা পেয়েছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা ।’

গত বছর রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে এরকম অসুস্থ আড়াইশো জন শ্রমিকের প্রোফাইল (বৃত্তান্ত) করা হয়েছে জানালেন বিলস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ) এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহমেদ।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, গত বছর রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে আড়াইশো জনের প্রোফাইল করা হয়েছিল যাদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এদের থরো চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেন, এসব শ্রমিকের জন্য এখন সবচেয়ে দরকার ট্রাস্ট ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। যাতে করে বড় হাসপাতাল বা বিশেষ হাসপাতালগুলোতে বোর্ড করে তাদের চিকিৎসা করা যায় এবং এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।

আবার মেডিকেল বোর্ড করে আবার শ্রমিকের কার কী সমস্যা রয়েছে সেগুলোর পূণর্মূল্যায়ন করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, দুর্ঘটনার পর এসব শ্রমিকদের যে ধরনের পুনর্বাসন দরকার ছিল সেটা হয়নি, নিজেরাও করতে পারেনি চিকিকৎসা।

‘তাদের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের দায়িত্বের অংশ এবং শ্রমিকদের অধিকার চিকিৎসা পাওয়া। আমরা গত বছর মাত্র শুরু করলাম এবং আমাদের লক্ষ্য সবার চিকিৎসা নিয়ে আবার কাজ করা’ বলেন সৈয়দ সুলতান আহমেদ।

সারাবাংলা/জেএ/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন