বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্যসম্মত নয়

September 7, 2022 | 6:32 pm

পলাশ চন্দ্র দাস

আপনি সরকারি যে কোনো মেডিক্যালে গেলেই বুঝতে পারবেন রোগীরা কতটুকু অসহায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে। আপনি দেখতে পারবেন কীভাবে অসহায় অবস্থায় অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আপনি আরো দেখতে পারবেন কীভাবে নোংরা পরিবেশে চিকিত্সা নিতে হয়। হাসপাতালের অন্দরমহল যে কতটা নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, পুতিগন্ধময়, তা হাসপাতালের রন্ধনশালায় ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায়। পচা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হাসপাতালের রোগীরা। বেশির ভাগ ওয়ার্ডের আশেপাশে নানা ধরনের বর্জ্য প্রতিনিয়তই ফেলে রাখা হচ্ছে। ক্লিনার-সুইপাররা কাজ না করে আড্ডা আর গল্প করে সময় পার করে। কেউ কেউ আবার রোগী ভর্তির বাণিজ্যে ব্যস্ত।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় মৌলিক ও পরিচ্ছন্ন পরিষেবার অভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে (হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অন্যান্য স্থান) স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী যেমন- হ্যান্ড স্যানিটাইজার, বিশুদ্ধ পানি ও সাবানের তীব্র অভাব রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনাগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় বেশ ত্রুটি রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

এর মধ্যে বাংলাদেশে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অনিয়ম ঠেকাতে স্বাস্থ্যখাতের অভিযান চলছে। দেশে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের অনিয়ম ঠেকাতে স্বাস্থ্যখাতের অভিযান চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে আরো জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেমন অব্যবস্থাপনা রয়েছে, তেমনই সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা আরো বেশি লক্ষ্য করা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ঢুকলে মনে হয় হাসপাতাল নয়, কোনো বস্তিতে ঢুকেছি। একটি ছোট কেবিনের মধ্যে ১০-১৫ রোগী এবং ১০-১৫ জন আত্মীয়-স্বজনের অবস্থান দেখে তাই মনে হওয়ার কথা। শুধু এক কেবিনে ৩০-৩২ জনের অবস্থান নয়, অনেকের জায়গা হয় হাসপাতালের মেঝেতে অথবা বারান্দায়। আমি আমার দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এই কথাগুলো বলছি। আপনি সরকারি যে কোনো মেডিক্যালে গেলেই বুঝতে পারবেন রোগীরা কতটুকু অসহায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে। আপনি দেখতে পারবেন কীভাবে অসহায় অবস্থায় অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আপনি আরো দেখতে পারবেন কীভাবে নোংরা পরিবেশে চিকিত্সা নিতে হয়। হাসপাতালের অন্দরমহল যে কতটা নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, পুতিগন্ধময়, তা হাসপাতালের রন্ধনশালায় ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায়। পচা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হাসপাতালের রোগীরা। বেশির ভাগ ওয়ার্ডের আশেপাশে নানা ধরনের বর্জ্য প্রতিনিয়তই ফেলে রাখা হচ্ছে। ক্লিনার-সুইপাররা কাজ না করে আড্ডা আর গল্প করে সময় পার করে। কেউ কেউ আবার রোগী ভর্তির বাণিজ্যে ব্যস্ত।

বিজ্ঞাপন

সরকারি পরিষেবা টয়লেটগুলোর পরিবেশ খুবই খারাপ অবস্থা। অনেক টয়লেটে ব্যবহারের পানিও থাকে না। বিশুদ্ধ খাবার পানিরও অভাব রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত, যাতে রোগীরা সঠিক ও সুন্দর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে।

বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য ও শিশুবিষয়ক দুটি সংস্থার এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, যেসব স্থাপনায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং রোগীরা যে টয়লেট ব্যবহার করেন, সেসব স্থানে পানি এবং সাবান বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজারও নেই।

বিশ্বের প্রায় ৩৮৫ কোটি মানুষ এসব স্থাপনা ব্যবহার করেন এবং তারা নিজেদের সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছেন। এমনকি তাদের মধ্যে প্রায় ৬৮ কোটি ৮০ লাখ মানুষ যেসব স্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন, সেখানে জীবাণুনাশক সামগ্রী বা স্বাস্থ্য পরিষেবা একেবারেই ছিল না। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা এবং সেগুলোর চর্চা নিয়ে কোনও আপোস নয়। মহামারি পরবর্তী পুনরুদ্ধার, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রস্তুতির জন্য এসব অপরিহার্য। স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনার স্বাস্থ্যবিধিতে নিরাপদ পানি, পরিষ্কার টয়লেট এবং স্বাস্থ্যসেবার বর্জ্য নিরাপদে অপসারণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব মৌলিক ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে সুরক্ষা বৃদ্ধি করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের ৬৮ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়। এছাড়া ৬৫ শতাংশ স্থাপনায় টয়লেটে পানি এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মাত্র ৫১ শতাংশ স্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি পালন এবং টয়লেটে পানি ও সাবান উভয়ই রয়েছে। আর এসব স্থাপনা মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি সেবার মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হয়েছে। তবে বিশ্বের প্রায় ৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই নেই। যদি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের স্বাস্থ্যবিধি পরিষেবা না থাকে, তাহলে রোগীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। নিরাপদ পানি, মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো গর্ভবতী মা, নবজাতক এবং শিশুদের জন্য একটি সম্ভাব্য মরণ ফাঁদ। প্রত্যেক বছর বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজার নবজাতকের প্রাণ যায় কেবল সংক্রমণের কারণে। কিন্তু এই শিশুদের মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য।

স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনার বেহাল দশায় সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল। এই অঞ্চলের মাত্র ৩৭ শতাংশ টয়লেটে সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৫৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় সুরক্ষিত পানির উৎসের পরিষেবা আছে।

বিশ্ব জুড়ে শহরাঞ্চলের প্রায় তিন শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকার ১১ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় পানির কোনও ব্যবস্থাই নেই। এছাড়া অনেক স্থাপনায় পরিবেশগত মৌলিক পরিচ্ছন্নতা, পৃথক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। সেটা হলো বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটি স্বাধীন, সার্বভৌম সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। বাংলার মানুষের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকে। এ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি গ্রহণ করেছিলেন সব রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে চাই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। এ জন্য তিনি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি গ্রহণ করেছেন সময়োপযোগী পদক্ষেপ। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন, যার ওপরে গড়ে উঠেছে আজকের বিশ্বনন্দিত অনেক কার্যক্রম।

বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে মজবুত একটি দেশ। অথচ দেশের এই সুন্দর সময়ে এসে মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো যাবে না, সেটি হতে পারে না। এবার স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

বৈধ কাগজ না থাকার কারণে সারাদেশে এ পর্যন্ত ৭০০টি অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একইসঙ্গে বন্ধ করা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ লাখেরও বেশি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

অবৈধভাবে পরিচালিত এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি ১৬৯টি বন্ধ হয়েছে খুলনা বিভাগে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ- ১৫৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৮১টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি, রংপুর বিভাগে ২৪টি, বরিশাল বিভাগে ১৩টি এবং সর্বনিম্ন একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে সিলেট বিভাগে।

জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। দেশের অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনিয়ম ঠেকাতে স্বাস্থ্য খাতের এই অভিযান চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে আরও জোরালো ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশ দিয়েছে, রোগী সেবা নিশ্চিত এবং অনিয়ম বন্ধে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংকের সাইনবোর্ডে তাদের লাইসেন্স নম্বর যুক্ত করার। নির্দেশনা না মানলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংকে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখসহ লাইসেন্স নম্বর সাইনবোর্ডে ঝুলিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে কিউআর কোডসহ সেটি ডিসপ্লে করতে হবে। নয়ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা এবং হাসপাতালগুলোয় স্বচ্ছতা আনতে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো এইরকম আরো অনেক সমস্যায় জর্জরিত, যার ফলে সাধারণ রোগীদের পোহাতে হচ্ছে নানারকমের দুর্ভোগ এবং রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের মৌলিক মানবাধিকার থেকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুষ্ঠু নজরদারিই পারে রোগীদের উন্নতমানের চিকিত্সা সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করতে।

লেখক: সংবাদকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন