বিজ্ঞাপন

‘জামায়াতমুক্ত’ আইআইইউসিতে বর্ণিল সমাবর্তন

September 11, 2022 | 8:30 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেড় বছর আগে ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জামায়াত ইসলামীর ‘নিয়ন্ত্রণমুক্ত’ হওয়া বেসরকারি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইইউসি) বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চম সমাবর্তন। এতে আচার্যের মনোনীত হিসেবে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আইআইইউসি ক্যাম্পাসে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, জামায়াতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ায় প্রথমবারের মতো এই ক্যাম্পাসে এত জাঁকজমকভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে। সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। পরিবেশন করা হয় জাতীয় সঙ্গীতও, যা জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার সময় কার্যত নিষিদ্ধ ছিল।

সভাপতির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ছিল। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করেছে। তারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাদের অনেকেই ইসলামকে ব্যবহার করে সংকীর্ণতার চাষ করেছেন। অথচ ইসলাম সহনশীলতার চর্চা করতে শিক্ষা দেয়। বর্তমানে যাদের দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন হয়েছে তারা অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আইআইইউসি ইসলাম ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। তবে ইসলাম ও মওদূদীবাদ এক নয়। মওদূদীবাদ সংকীর্ণতা ও অস্থিতিশীলতার শিক্ষা দেয়। পাকিস্তান আমলে ইসলাম ও রাজনীতিকে এক করা হয়েছিল, যার কারণে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই অস্থিতিশীলতা থেকে বাঙালির মুক্তির জন্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা এক নয়। বর্তমান সরকার ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। সেখান থেকে পাস করে অনেকে দক্ষতা না থাকার কারণে ভালো চাকরি করতে পারছে না। তাই তাদের দক্ষতা বাড়াতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষ হতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের এক থেকে দুই শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হতে পারে। কিন্তু বাকিরা দক্ষতা না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে।’

সমাবর্তন বক্তব্য দেন- ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত। আরও বক্তৃতা করেন- আইআইইউসি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ, আইআইইউসি’র উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মছরুরুল মওলা, ট্রেজারার প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির, শরীয়াহ ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডিন শাকের আলম শওক, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন আকতার সাঈদ।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সমাবর্তনে মোট ১৫ হাজার ৩৬১ জনকে সনদ বিতরণ করা হয়েছে এদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ে ৯ হাজার ৪৫৯ জন এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৫ হাজার ৯০২ জন। চ্যান্সেলর স্বর্ণ পদক দেওয়া হয়েছে ৩৬ শিক্ষার্থীকে। এছাড়া ভাইস চ্যান্সেলর এওয়ার্ড দেওয়া হয় ১৩৭ জন শিক্ষার্থীকে।

আইআইইউসি এই সমাবর্তনে প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করেছে বোর্ড অব ট্রাস্টি চেয়ারম্যান স্বর্ণপদক। প্রথমবার শরীয়াহ অনুষদের শিক্ষার্থী জোবাইদুন নাহার পান্নাকে এ পদক দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থার সিংহভাগ অর্থায়নে ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও দুটি ক্যাম্পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ক্যাম্পাস বন্ধ করে এখন শুধুমাত্র সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে পাঠদান চলছে।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ ছিল, একসময় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ছাড়া কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো না। শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা হতো। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়টি নাশকতা ও সহিংসতার পরিকল্পনা ও সংঘটনের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। শুরু থেকেই গোলাম আজমসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতারাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেপথ্যের নিয়ন্ত্রক ছিলেন, যাদের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন।

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের একপর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াত ঘরানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্জনের যে জোরালো দাবি উঠেছিল, তাতে এই আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও ছিল।

প্রতিষ্ঠার পর ২৬ বছর ধরে জামায়াত ঘরানার লোকজন দিয়ে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা হয়ে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) আসনের সাবেক সাংসদ ও মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম এবং তার অনুসারীদের। একই আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ও বিদেশ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। পরে তাকে বিদেশ বিভাগের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

নদভীর অনুসারীদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী সাংসদকে বিদেশ বিভাগের পদ থেকে সরিয়ে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কৌশলে বের করে দেন জামায়াত নেতা আ ন ম শামসুল ইসলাম। এ অবস্থায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ দুই বছরের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়। ২০২১ সালের ১ মার্চ শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়, যাতে সভাপতি করা হয় সাংসদ নদভীকে। ২১ জন নিয়ে গঠিত ট্রাস্টিবোর্ডের অধিকাংশই সরকারি ঘরানার হিসেবে পরিচিত।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন