বিজ্ঞাপন

জন্ম থেকে জ্বলছে জাতীয় পার্টি

September 12, 2022 | 10:00 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জন্ম থেকে জ্বলছে জাতীয় পার্টি। দলটি ভেঙেছে পাঁচবার। আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে। সবই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে হয়েছে। আগামী ২৬ নভেম্বর বেগম রওশন এরশাদের ডাকা জাতীয় সম্মেলনে দলটি আরেক দফা ভাঙনের সম্মুখীন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে দলের নেতা-কর্মীদের হস্তক্ষেপে জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আর তা না হলে জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পর্টি কাদের নামে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করবে বলে জানিয়েছে দলের নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা আরও জানিয়েছে, দলটি যেন না ভাঙে সে জন্য মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে দলটির মহানগর কমিটির নেতারা। রওশন এরশাদ দেশে ফিরলে মীমাংসার উদ্যোগ প্রকাশ পাবে।

বর্তমান পরিস্থিতি সর্ম্পকে দলটির বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সম্প্রতি সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। দলের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার তার নেই। তবে বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার ১ এ তাকে কাউন্সিল ডাকার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ২০ ধারার ১ সর্ম্পকে মুজিবুল হক চুন্নুকে বলা হলে তিনি বলেছেন, গঠনতন্ত্র ভালো করে পড়ে দেখতে।

একপর্যায় মুজিবুল হক বলেন, ‘মূল ধারার জাতীয় পার্টির কর্ণধার জি এম কাদের। এরপর কেউ যদি জাতীয় কাউন্সিল ডাকেন সে বিষয় নিয়ে তাদের হেডেক নেই। অর্থাৎ মাথাব্যথা নেই।’

বিজ্ঞাপন

বেগম রওশন এরশাদ, জি এম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে নেতাকর্মীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতি মিমাংসা না হলে মূল ধারার জাতীয় পার্টি নিশ্চিত আবার ভাঙ্গছে। তবে দলীয় সংসদ সদস্যরা কোন দিকে থাকবে সেটি নিয়ে তাদের মাঝে প্রশ্ন জেগেছে।

এ সর্ম্পকে জাতীয় পার্টির দলীয় সংসদ সদস্যরা যদিও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। তারা চুপচাপ রয়েছেন। নাম গোপন রাখার শর্তে অনেকেই বলেছেন, সময়মতো সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। কেউ বলছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বেগম রওশন এরশাদের পক্ষে সব সংসদ সদস্যরা থাকবে। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে কোন দিকে থাকবে তা নিয়েও তারা হিসাব-নিকাশ করবে।

দলটির অধিকাংশ সংসদ সদস্য বলেছেন, বিএনপি তো জাতীয় পার্টিকে কখনও বিশ্বাস করেনি। জাতীয় পার্টির বিএনপিকে বিশ্বাস করে না। আর জাতীয় পার্টি একক ভাবে নির্বাচন করলে দলটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ দলটিতে যোগ্য প্রার্থীর সংকট। বর্তমানে যারা এমপি রয়েছেন তাদের মধ্যে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর আসনটি নিশ্চিত ধরা যেত পারে। কারণ তিনি এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। বৃহত্তর রংপুরে প্রায়ত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আসনটি পেতে পারেন তার ছেলে সাদ এরশাদ। জি এম কাদেরের আসনটি নিশ্চিত নয় বলে জানান দলের নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

দলের সিনিয়র একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, দলটির শুরু থেকে জ্বলতে শুরু করেছে। কারণ ১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্টের ধানমন্ডিস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

জাতীয় ফ্রন্টের ৫টি শরিক দল একত্রিত হয়ে জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং মহাসচিব নিযুক্ত হন অধ্যাপক এম এ মতিন। পার্টির কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত-জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আনোয়ার জাহিদ।

সাংবাদিক সম্মেলনে ফ্রন্টের শরিক দল জনদল, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি, বিএনপি (শাহ) মুসলিম লীগ (সা) নিজেদের অস্থিত্ব বিলুপ্ত ঘোষণা করে জাতীয় পার্টিতে একীভূত হয়। ওই দিনটি ছিল প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর প্রথম দিন।

১৯৮৫ সালের ১৬ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি এরশাদের নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের বাইরেও অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক নেতা ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণার দিনে তারাও জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। পার্টি গঠনের ঘোষণায় বলা হয় দেশের সকল গণতন্ত্রকামী জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর বিভক্তির প্রবণতা কাটিয়ে একটি একক রাজনৈতিক দলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে জাতীয় পার্টি গঠন করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণার দিনে প্রথমে ২১ সদস্যের প্রেসিডিয়াম, ৫৭ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটিসহ ৬০১ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

প্রথম দিনে ২১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের মধ্যে ১৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এরা হলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, মওদদ আহমদ, কাজী জাফর আহমেদ, সিরাজুল হোসেন খান, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, এম কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, একেএম মাঈদুল ইসলাম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আমিনুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, শামসুল হুদা চৌধুরী, এমএ সাত্তার ও বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম। নবগঠিত কমিটিতে ৩ জন যুগ্ম মহাসচিব নিয়োগের ঘোষণা করা হয়। এরা ছিলেন, সফিকুল গণি স্বপন, মোস্তোফা জামাল হায়দার এবং লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম।

জাতীয় পার্টি ঘোষণার দিনে ৫৭ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটির নামও ঘোষণা করা হয়। ৫৭ সদস্যের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর এম এ মতিন, আনোয়ার জাহিদ, শফিকুল গনি স্বপন, লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম, সুনীল গুপ্ত, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাইনুদ্দিন ভূঁইয়া, জিয়াউদ্দিন বাবলু, মেজবাহউদ্দিন বাবলু, শেখ শহীদুল ইসলাম, মিসেস মমতা ওহাব, প্রফেসর ইউসুফ আলী, শামসুল হক, কর্নেল (অব.) এম আনোয়ারউল্লাহ, উপেন্দ্রলাল চাকমা, কামরুন্নাহার জাফর, ব্যারিস্টার আবদুল হক, এসএ খালেক, জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল, নাজিমুদ্দিন আল আজাদ, মাহবুবুল হক দোলন, মনিরুল হক চৌধুরী, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ খান, এনামুল করীম শহীদ, অধ্যাপক আবদুস সালাম, ডা. মনসুর আলী, রুহুল আমিন হাওলাদার, পলাশ আনোয়ার মতি, অ্যাডভোকেট ফয়েজ, সেকেন্দার মিয়া, শামসুজ্জামান মিন্টু, খুররম খান চৌধুরী, হাসিম উদ্দিন আহমেদ, এসবি জামান, আশরাফ আলী খান, মামদুদ চৌধুরী, নুরন্নবি চাঁদ, আবুল খায়ের চৌধুরী, রেদোয়ানুল হক চৌধুরী (ইদু), ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল, কাজী মুজিবুর রহমান, ব্যারিস্টার জামাল হোসেন ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট রিয়াজুল হক চৌধুরী, আবদুর রহীম আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, হারুনুর রশীদ, খালেদুর রহমান টিটো, আসগর আলী, একরামুর রসুল, কেজি করিজন আলী, নূর রহমান খান শাজো, আদিলউদ্দিন হাওলাদার, সরদার সুলতান মাহমুদ, আবদুল আলী বুলবুল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মহসীন ও সাইফুদ্দিন আহমদ।

জাতীয় পার্টির গঠনের ঘোষণাকালে সামরিক শাসন থেকে সাংবিধানিক শাসনে উত্তরণের পরিবেশ অধিকতর উন্নত করার জন্য পার্টির ৫টি আশু কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়। সেগুলো ছিল: (১) স্থগিত সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহের ভিত্তিতে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচনসমূহ অনুষ্ঠান (২) নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সামরিক আইনের অবসান এবং স্থগিত সংবিধান পরিপূর্ণরূপে পুনরুজ্জীবন (৩) অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ। নির্বাচনের পূর্বে সামরিক আইন সংকোচন ও সামরিক আদালত, সামরিক ট্রইব্যুনাল প্রত্যাহার (৪) নির্বাচনের আগে ক্রমান্বয়ে স্থগিত সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও হাইকোর্টের রিট এখতিয়ার সংক্রান্ত ধারাসমূহ পুনর্বহাল এবং (৫) রাজনৈতিক আটক সব দেশপ্রেমিক বন্দির মুক্তি দান। তার মতে শুরুর দিন থেকে দলটির মধ্যে ষড়যন্ত্র পদ-পদবি এবং দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে আসছে।

তিনি বলেন, ‘এই দলটির অধীনে কখনওই অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। দলটির গঠনতন্ত্রে স্বৈরাচারী ধারা রয়েছে। যে ধারাটিতে চেয়ারম্যানকে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’

সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন