বিজ্ঞাপন

পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প

September 28, 2022 | 8:22 am

আশরাফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: সীমান্তঘেঁষা পদ্মা নদীর মাঝে ১৯৮৮ সালের দিকে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দশ রশিয়া থেকে সদরের উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত জেগে উঠে বিস্তৃর্ণ চর। এরপর সেখানে শুরু হয় বসতি স্থাপন। পদ্মা নদীতে বসতবাড়ি হারিয়ে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ এই চরে আশ্রয় নেয় পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা। গড়ে উঠে জনপদ। এরপর প্রায় ৩০ বছরে এখানকার জনসংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫০-৬০ হাজার। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের দেওয়া সকল সুযোগ সুবিধা পেতে থাকেন তারা।

বিজ্ঞাপন

মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরত্ব থাকলেও ভারতঘেঁষা এই জনপদের মানুষ পায় সরকারি সকল সহায়তা। চরের ফসলি জমির উর্বরতাকে কাজে লাগিয়ে তারা উৎপাদন করে মাসকলাই, ধান, কলা, পাট, ভুট্টাসহ নানান ফসল। অন্যান্য জমির তুলনায় ফলনও হয় ব্যাপক। সবমিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে এই চরের প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দেয়। গত ৪ বছরের তুলনায় এবার তীব্র আকার ধারণ করেছে নদী ভাঙন।

এর মধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। তাদের অধিকাংশ নদীর ওপারের নিশিপাড়া চরে নতুন করে আবাসন গড়েছেন। হুমকিতে পড়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে গতবছরের সংযোজন করা সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে চরে বিদ্যুৎ সংযোগ। ভারত থেকে বয়ে আসা পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙনে এর মধ্যে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি ও বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ-মাদরাসা। এখন ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি বিজিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি রয়েছে ভাঙনের হুমকিতে।

বিজ্ঞাপন
পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
ভাঙনের কবলে কলা বাগান, ছবি: সারাবাংলা
বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সাল থেকে শুরু হওয়ার পরই ভাঙনরোধে ভূমিকা নিলে বর্তমানে ভাঙনের তীব্রতা এতো বেশি হতো না। চরের শিবগঞ্জের পাঁকা ইউনিয়নের দশরশিয়া বাজারে দোকানপাট ভাঙতে গেছে স্থানীয়দের। এছাড়াও নদীর কাছাকাছি যাদের বসতবাড়ি চলে এসেছে, তারাও বাড়ির আশেপাশের থাকা গাছপালা কেটে বাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই চরে থাকা বাসিন্দারা নদী ভাঙনের কবলে পড়েই এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আবার নদী ভাঙনের কারণেই এই চরে গড়ে উঠা জনপদ ছেড়ে আরেক চরে আশ্রয় নিচ্ছেন পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা।

দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের আলী বলেন, ‘গত ৪ বছর ধরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এখানকার মানুষ সব হারালেও তা রোধে কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়নি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে নদী ভাঙন রোধে কাজ শুরুর কথা বারবার আসলেও তার বাস্তবায়ন দেখতে পায়নি। এর মধ্যে এই এলাকায় আমরা অনেকগুলো মসজিদ মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হারিয়েছি। নদী ভাঙন ঠেকাতে উদ্যোগ নিলে এসব রক্ষা করা সম্ভব হতো। সরকারের নিকট আকুল আবেদন, এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের রক্ষা করুন।’

বিজ্ঞাপন
পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
দোকানপাট সরিয়ে নিয়েছেন চরবাসী, ছবি: সারাবাংলা
বিজ্ঞাপন

কলেজ শিক্ষার্থী শামীম রেজা বলেন, ‘ভাঙনের কবলে পড়ে দক্ষিণ পাঁকা চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। যেখানে বাড়ি করা হয়, সেটি নদী থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল। কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে এখন নদীর খুব কাছে চলে এসেছে। বাধ্য হয়ে আবার বাড়ি ভাঙতে হবে আরেক জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এক ইঞ্চি জমিও যাতে ফাঁকা না থাকে। তাহলে আমরা কেন নিজেদের এক ইঞ্চি জায়গাও নদীতে ভাঙতে দেব? তাই সরকারের নিকট আকুল আবেদন এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

আরেক শিক্ষার্থী সুমন আলী বলেন, ‘প্রতিবছর এখানে নদী ভাঙন হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে সব ঘরবাড়ি ফসলি জমি মসজিদ-মাদরাসা নদীর কবলে হারিয়ে যাচ্ছে। এবার ভাঙন বেড়েছে যার কারণে দ্রুত ঘরবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। এখানে বড় একটা হাট ছিল। সেখানকার অনেক দোকানপাট ছিল। সেই হাটের কিছু অংশ নেমে গেছে, তাই আশেপাশের দোকানগুলো এখন ভেঙে নেওয়ার কাজ চলছে।’

পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
ছবি: সারাবাংলা

‘সকাল, বিকেল, দুপুর, রাত কিছুই মানেনা সর্বনাশা পদ্মা নদী। সবসময় ভেঙে যাচ্ছে। নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজ ভেঙে যাওয়ার কারণে সব বন্ধ আছে তাদের পড়াশোনা হয় না’- এভাবেই বলছিলেন গৃহবধূ মনিরা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাড়িও নদীর খুব কাছে চলে এসেছে, তাই বাড়ির আশপাশে থাকা সকল গাছ কেটে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাব। একটি গাছ মানুষ করা, আর একটি ছেলে মানুষ করা প্রায় সমান। যে গাছ এত যত্ন করে বড় করেছি, তা কেটে ফেলতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আকুল আবেদন, দ্রুত এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে এই জনপদকে রক্ষা করুন।’

ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলেন, ‘পদ্মা নদীর ভাঙনের নিয়মই এমন। গত কয়েক দশক ধরে আমরা যখন দক্ষিণ দিক ভেঙে যায়, তখন উত্তর দিকে এসে আশ্রয় নেয়। আবার উত্তর দিক ভেঙে গেলে দক্ষিণ আশ্রয় নেয়। এভাবেই চলছে আমাদের জীবনযাপন। একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করলে এভাবে কিছু পদ্মা নদীতে তলিয়ে যাবে না সবকিছু, আমরা হারাব না ভিটেমাটি।’

পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
ছবি: সারাবাংলা

নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজির হোসেন জানান, ২১০৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁকা ও নারায়নপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাঙন শুরু হয়েছে। নারায়ণপুরের তুলনায় পাঁকা ইউনিয়নে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে চলতি বছরে। ২০১৮ সালে ভাঙনের শুরুর সময় যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে ভাঙনের তীব্রতা এবছর এতো বেশি দেখা যেত না। ভাঙনের তীব্রতা এমন যে, পাঁকা ইউনিয়নের দুইটি ওয়ার্ড নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি বিজিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি হুমকিতে রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘দশ রশিয়া থেকে বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ভাঙনটা খুব তীব্র। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাধারণত চর এলাকায় কাজ করে না। কিন্তু এই চরের বাসিন্দারা সরকারের সকল সুবিধা পেয়ে থাকেন এবং জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের যোগাযোগের ফলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ভাঙনরোধে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।’

পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
পাড় ভাঙছে পদ্মা নদীর, ছবি: সারাবাংলা

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে পাঁচ কিলোমিটারের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। এছাড়াও এখানে পাথর ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আসা অনেক কষ্টসাধ্য। একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা কম খরচে কিভাবে স্থায়ী সমাধান সম্ভব তার প্রতিবেদন দেবেন। গত শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) থেকে চর পাঁকার পয়েন্ট থেকে ৩৩০টি জিও টিউব ও ১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, ‘জিও টিউব ও জিও ব্যাগ দিয়ে বালু ঢুকিয়ে স্রোতের বাঁধা সৃষ্টি করে ১০টি জায়গায় ফেলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন থেকে এই এলাকা রক্ষা পাবে বলে আশা করছি। এছাড়াও জিও ব্যাগে বালু ও সিমেন্ট মিশিয়ে নদী পাড়ে ভাঙন রোধে বাঁধা প্রদানে আরও একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। নদী ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, তাদের মনের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তাদের আশ্বস্ত করেছি, সরকার তাদের পাশে রয়েছে।’

পদ্মার ভাঙনের মুখে ২৫ বিদ্যালয়, ৫ বিজিবি ক্যাম্প
ছবি: সারাবাংলা

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশ হলো, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাই সরেজমিনে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও অসহায়ত্বের কথা শুনেছি৷ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, সরকারের সকল সুবিধা তারা পাচ্ছে। এছাড়া নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝেও সহায়তা প্রদান করা হবে। নদী ভাঙন রোধে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বরাদ্দের কাজ কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/এনএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন