বিজ্ঞাপন

চট্টলার অগ্নিশিশু জাফরুল আলম খান ও ‘পূর্ব বাংলা মুক্তি সঙ্ঘ’

September 30, 2022 | 7:00 pm

কবীর আলমগীর, জয়েন্ট নিউজ এডিটর

ঢাকা: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর গোটা দেশ। ফুঁসে উঠতে শুরু করে সাধারণ জনতা। এমন উত্তাল মুহূর্তে বসে ছিলেন না বীরভূমি চট্টলার ১৬ কিশোর। যার নেতৃত্বে ছিলেন ‘অগ্নিশিশু’ জাফরুল আলম খান। ওরা চিন্তা করলেন এই অগ্নিগর্ভ সময়ে পূর্ব বাংলার জন্য কিছু না কিছু করতেই হবে। যে কথা সেই কাজ। ‘অগ্নিশিশু’ জাফরুল আলম খান তখন সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র। তিনি সিটি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমমনা তরুণদের বোঝাতে শুরু করলেন, দেশের জন্য তাদের ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে। একে একে দলে ভিড়লেন ১৬ শিশু। তৈরি হলো গুপ্ত সংগঠন ‘পূর্ব বাংলা মুক্তিসঙ্ঘ।’

বিজ্ঞাপন

১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে— যা ইতিহাসে ‘আগরতলা মামলা’ বা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে সুপরিচিত। এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

ওই মামলার প্রতিবাদে সে সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল গুপ্ত সংগঠন ‘পূর্ব বাংলা মুক্তিসঙ্ঘ।’

মুক্তিসঙ্ঘের সদস্যরা রাত জেগে পোস্টার মারতেন। পোস্টারে উল্লেখ করতেন, আগরতলার মামলা মানি না। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চাই। একসময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারিতে পড়েন মুক্তিসঙ্ঘের সদস্যরা।

বিজ্ঞাপন

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাতের আঁধারে একদিন হানা দেয় আসকারদীঘির পশ্চিমপাড়ে জাফরুল আলম খানের বাসায়। বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যায় গোপন কর্মকাণ্ডের পোস্টার ও কিছু নথি। ডিফেন্স অব পাকিস্তানি রুল অনুযায়ী হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটনের অপরাধে গ্রেফতার করা হয় জাফরুল আলম খান ও কয়েকজন সহযোগীকে।

জেলে পাঠানো হয় পূর্ব বাংলা মুক্তিসঙ্ঘের প্রধান জাফরুল আলম খানকে। মাসের পর মাস জেলে কাটে বিনা বিচারে। তবে জেলেও বসেছিলেন না জাফরুল আলম খানরা। সেখানে বিপ্লবী পুর্ণেন্দু দস্তিদারের সাহচর্য লাভ করেন তারা। বিপ্লবী পুর্ণেন্দু দস্তিদার তাদের সাহস জোগাতেন, অভয় দিতেন। এরইমধ্যে জেলে প্রায় ২৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বিপ্লবী পুর্ণেন্দু দস্তিদার।

অগ্নিশিশু জাফরুল আলম খান ও সহযোদ্ধাদের ৬৯ সালে সংবর্ধনা দেয় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা

অগ্নিশিশু জাফরুল আলম খান ও সহযোদ্ধাদের ৬৯ সালে সংবর্ধনা দেয় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে উত্তাল পূর্ব বাংলা। চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজ ওই সময় জেল ঘেরাও করে। অবস্থা বেগতিক দেখে কারাবন্দিদের মুক্তির সিদ্ধান্ত আসে। এক সময় জামিন হয় জাফরুল আলম খান ও তার সহযোগীদের।

বিজ্ঞাপন

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘীর মুজিব পার্কে ‘অগ্নিশিশু’ জাফরুল আলম খানসহ তার সহযোগীদের সংবর্ধনা দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ছাত্রলীগের সংগ্রামী নেতা ছৈয়দ আহমদ, মোহাম্মদ ইউছুপ, ছাবের আহমদ আজগারীর পাশাপাশি সংবর্ধনা জানানো হয় চট্টলার অগ্নিশিশু জাফরুল আলম খান, ওসমান গণি খান, হারুনুর রশীদ শাহ, সামসুল হক খোকন ও কাজী এনামুল হককে।

সংবর্ধনা বার্তায় বলা হয়, ‘… জাতি এখনও স্বেচ্ছাচারের নিগড়ে আবদ্ধ। এখনও বাস্তবায়িত হয়নি ৬ দফা দাবি, পূরণ করা হয়নি ছাত্রদের মুক্তি সনদ ১১ দফা। তাই সমস্ত দেশ বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করছে দেশের মুক্তি ছাড়া আন্দোলনে বিরতি নেই।’

‘হে সাহসী সৈনিকেরা, আত্মত্যাগের ইতিহাসে তোমাদের কথা স্বর্ণ আখরে লিপিবদ্ধ থাকবে, জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে তোমাদের কথা। অশ্রু, রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে আমরা প্রতিষ্ঠা করব। সেই চরম সত্যের দেশের মালিক দেশবাসী। জনতার রায় চূড়ান্ত।’

মূলধারার ইতিহাসে নিচে চাপা পড়া চট্টলার এই নায়ক জাফরুল আলম খান মারা গেছেন ২৩ সেপ্টেম্বর। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় জাফরুল আলম খানদের অবদান বিস্তারিত আলোচিত না হলেও তা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই পরিবারের। জাফরুল আলম খানের ভাই বদরুল আলম খান ওই সময়ের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবা সোলায়মান খান খুবই রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন তার ছেলেরা কিছু না কিছুতে যুক্ত হয়েছে। তিনিও তাতে মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন।’

বিজ্ঞাপন
ভাই জাফরুল আলম খানের স্মৃতিচারণে বড় ভাই বদরুল আলম খান

ভাই জাফরুল আলম খানের স্মৃতিচারণে বড় ভাই বদরুল আলম খান

বদরুল আলম খান বলেন, ‘একাত্তরে আমার ছোট ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন। ভারত সীমান্ত সংলগ্ন আগরতলা-কুষ্টিয়া এলাকায় ছিল তার যুদ্ধ এলাকা। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের গুলিতে মারা যান একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবার কাছে খবর এলো, আপনার ছেলেও পাকবাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন। এই খবরে বাবা বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না, তার ছেলে মারা যেতে পারেন।’

জাফরুল আলম খানের বাবা সোলায়মান খানের উচ্চারণ ছিল, ‘আমার ছেলে মারা গেছে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না। আমার ছেলে মারা গেলে দেশ স্বাধীন হবে কীভাবে?’

‘৩/৪ মাস পর ছোট ভাই জাফরুলের চিঠি পেলাম। ওই চিঠি পেয়েই নিশ্চিত হলাম সে মারা যায়নি—’ বলেন বদরুল আলম খান।

বদরুল আলম খান বলেন, ‘আমার ভাই উচ্চতায় ছোটখাটো ছিল। কিন্তু তার ছিল অস্বাভাবিক তেজ, অত্যন্ত সাহসী একজন কর্মী ছিল।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতির দীক্ষা আমরা পরিবার থেকেই পেয়েছিলাম। আমার বাবা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাবাকে ডেকে বললেন, আপনাকে নির্বাচন করতে হবে। বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলেন। কিন্তু বাবা শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পেলেন না। তার জায়গায় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বাবা খুব মন খারাপ করলেন।’

‘বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন আবার নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেন না। তিনি অভিমান করে কুষ্টিয়া থেকে সোজা চলে এলেন চট্টগ্রামে। সেই থেকে আমরা চট্টগ্রামে থিতু হলাম—’ বলেন বদরুল আলম খান।

রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতি উল্লেখ করে ৬২ এর এই ছাত্র আন্দোলন কর্মী বলেন, ‘আমি মাধ্যমিক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ছিলাম। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল ঘোষণা করা হলো। হরতালের আগের রাতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এলেন আমাদের বাসায়। তিনি বাবাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন হরতালের দিন স্কুলে না যাই। বাবা প্রধান শিক্ষককে বললেন, ‘আচ্ছা। দেখি।’

‘স্কুলের প্রধান শিক্ষক চলে গেলেন। বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলায় চলে গেলাম স্কুলে। ওই দিনের হরতালে অংশগ্রহণ করেছি।’

‘অগ্নিশিশু’ জাফরুল আলম খান প্রয়াত হলেও বেঁচে আছেন পূর্ব বাংলা মুক্তি সঙ্ঘের অন্যতম সহযোদ্ধা সামসুল হক খোকন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবাদের জন্য আমরা ছিলাম ১৬ জন। রাতের আঁধারে পোস্টারিং করতাম। মিছিলের সম্মুখে থাকতাম। আমাদের এ সব কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়ি, জেলেও যেতে হয়েছে আমাদের।’

সামসুল হক খোকন বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবে এই বিষয় মাথায় রেখে তো আমরা কাজ করিনি। আমরা কাজ করেছি নেতা শেখ মুজিবের জন্য, কাজ করেছি দেশের জন্য। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে এটিই আমাদের পরম তৃপ্তি।’

সারাবাংলা/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন