বিজ্ঞাপন

‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’, মহামারিতে মৃত্যু-জীবনের মেলবন্ধন

October 23, 2022 | 7:42 pm

শরিফা উম্মে শিরিন

দিনটি ছিল ১৭ মার্চ, ২০২০; রোজ মঙ্গলবার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূরণের প্রাক্কালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্তনখোলা হলে সহকর্মী পরিবেষ্টিত পরিবেশে এক আলোচনা সভায় পূর্ণ মনোযোগ। হঠাৎ ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের সরকারি ছুটির ঘোষণা এলো।

বিজ্ঞাপন

এর আগেই চাপা গুঞ্জন বিরাজ করছিল যে, যেকোনো সময় ছুটির ঘোষণা আসতে পারে। কারণ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহান শহুরে আবির্ভূত হওয়া নতুন এক ভাইরাস যার নাম- করোনা ভাইরাস। মাত্র দুই মাসে বিদ্যুতের বেগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী দেশগুলো এই ভাইরাসের সংক্রমণে নাকাল। ডিজিটাল যুগের অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিও এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে লাখ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে শুরু করে। গ্লোবালাইজেশনের যুগে কোভিড-১৯ হিসেবে বহুলভাবে পরিচিত মরণঘাতী এই ভাইরাসের ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ে মার্চ মাসে। ডব্লিউএইচও-এর মতে, ৫ মে ২০২২ পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় মোট দেড় কোটি মানুষ মারা গেছে, আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭ কোটি ছাড়িয়েছে।

টেকনোলজির উল্লম্ফনে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল রূপ নিয়ে হাজির করোনাভাইরাসে সমগ্র পৃথিবীর যখন টালমাটাল অবস্থা, জীবনের চাকা যখন ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে, দিকে দিকে মৃত্যুর মিছিল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সভা-সমাবেশ, শিক্ষাদান সমস্ত কর্মকাণ্ড যখন স্থবির হয়ে পড়েছে; তখনও থেমে থাকেনি কবির কলম। লাশের মিছিল, অসংখ্য মানুষের স্বজন হারানো আর্তনাদ, তাদের বাঁচার আকুতি কবির চিন্তা জগতে অবিরত আলোড়িত করে, যা কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। করোনা মহামারির বাস্তব চিত্র নিয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় কবিতার বই বের হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে বাংলা ভাষায় তারুণ্যের কবি আলীম হায়াদরে ছোট-বড় মোট ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ কাব্যগ্রন্থটি।

দৈনন্দিন জীবনের নানা চিত্র কবির কবিতায় যেমন সাবলীল ভাষায় ফুটে উঠেছে, ঠিক তেমনি নানা রোগ-ব্যাধিসহ মহামারির চিত্রায়ন করেন কবি নানান উপমায়। করোনা মহামারি পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য মহামারির মতো নয়। এই মহামারিতে অতি অল্পসময়ে একসাথে উন্নত-অনুন্নত সকল দেশের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে করোনাভাইরাসের নিষ্ঠুরতা অতি নিপুণ ভাষায় তুলে ধরেছেন কবি। কবি বলেছেন-

বিজ্ঞাপন

‘নগরের কোলাহল গুম হয়ে যায় ক্রমেই, লুটপাট হতে থাকে অদম্য
আশার দিনগুলো, বিষাদের মখমলে সেজে ওঠে সফেদ শবাধার,
হৃদয়ের বলাকা জুড়ে শুধুই মৃত্যুর ঘোড়াদের হ্রেষা-ধ্বনি শুনি-’

কোভিড-১৯ সমগ্র পৃথিবীর ছোট-বড়; ধনী-দরিদ্র সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে একসাথে মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটানা প্রায় দেড় বছর এই ভাইরাসে মৃত্যুভয় ছিল নিত্যদিনের সাথী। কবির মনেও মৃত্যু ভয় ঢুকিয়েছিল এই মহামারি! তাইতো কবিতার ভাষায় তা প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে এভাবে-

‘ছাতা দিয়ে বজ্রাঘাত ঠেকানো যায় না
মাথার উপর ওটা শুধুই সান্ত্বনা
প্রেমিকের বুকে মুখ গুঁজে মৃত্যুভয় কাটে না।’

বিজ্ঞাপন

এই কাব্যগ্রন্থে কবির দার্শনিক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনবোধ সম্পর্কে তার গভীর দর্শনের প্রকাশ পেয়েছে কবিতায়। একইসাথে জনাকীর্ণ জায়গায় গেলেই করোনা সংক্রমণের বিষয়েও তিনি মানুষকে সতর্ক করেছেন কবিতার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন-

‘জন্মের আগে একা ছিল জঠরের সময়গুলো-
মৃত্যুর পর কাফন মুড়িয়ে আসে চির একাকীত্ব
জীবন হলো নদীর উপর উড়তে উড়তে থাকা সাঁকো
করোনাভাইরাস অমোঘ নিঃসঙ্গতা মনে করালো
তুমুল কোলাহল মানে আইসোলেশনের প্রতীক্ষা
মানুষ শুধুই নিজের পাহারাদার, বাকি সব মিথ্যা।’

করোনার সময়ে আর্থ-সামাজিক, এমনকি মানুষের সামাজিক আচরণের ব্যাপক পরিবর্তনের সুস্পষ্ট চিত্রায়ন দেখা যায় কবিতায়। এমনকি এই মহামারির সময়ে মানুষের মনোজগতের ব্যাপক পরিবর্তনও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। সামাজিক জীব হয়ে একত্রে বসবাসই ছিল মুখ্য বিষয়। বহুযুগের এই অমোঘ রীতির গোঁড়ায় করাঘাত করে করোনাভাইরাস। এসময় করোনায় মৃত বাবা-মায়ের লাশ ফেলে যাওয়া কিংবা নাড়ী-ছেঁড়া ধন সন্তানের লাশও ফেলে যাওয়া, বা প্রিয় মানুষের লাশের সৎকারে অংশ না নেওয়ার নিষ্ঠুর বাস্তবতাও কবি আলীম হায়দার তার কবিতায় তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তিনি বলেছেন-

‘এই বসন্ত মানুষের মুখোশ খুলে দিয়ে গেছে—
মায়ের কবরে মাটি দিতে যায়নি নাড়ি-ছেঁড়া ছেলে
আইসোলেশনে-থাকা প্রিয়মুখের কথা মনে হলে সবাই হাত ধুচ্ছে’

বিজ্ঞাপন

বাবা-মা; আত্মীয়-স্বজনের লাশ দাফনে প্রিয়জনেরা এগিয়ে না এলেও, অনাত্মীয় হলেও মানুষরূপী দেবতারা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছে বীরদর্পে, যা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-

‘স্বজনহীন লাশের সৎকারে নেই শোকের ছায়া
তবুও অচেনা আত্মীয় শুধু আত্মায় বাঁধে আত্মা।’

চারিদিকে লকডাউনের নির্জনতা, কোয়ারেন্টাইনের ঘরবন্দি নিঃসঙ্গতা, আইসোলেশনে মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদ, লাশের মিছিলে ভারী বাতাসের গুমোট পরিবেশেও প্রকৃতির অভাবনীয় পরিবর্তন কবির দৃষ্টি কাড়ে। শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া ও বজ্রে প্রাণহীন মৃতপ্রায় পৃথিবীর হঠাৎ সবুজ-শ্যামলিমায় ভরে ওঠার দৃশ্যও চিত্রিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। প্রকৃতিপ্রেমী কবি করোনার আঘাতে জবুথুবু পৃথিবীর প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার দেখেছেন, প্রেম অবলোকন করেছেন, পৃথিবীর বাঁচার আকুতিকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছেন-

‘এবারের বসন্তে অবলা পৃথিবী নিজেকে বাঁচানোর প্রতিঘাত করেছে
শোকের সুরেলা বিউগলে ধূসর গ্রহ জুড়ে অবিরাম প্রাণকলি ফুটেছে।’

সমকালীন এই কবি আরও বলেছেন-

‘কুশির ফাঁকে ফাঁকে ফুল খেলানোর সময় এটা
কোয়ারেন্টাইনে আছে নদী- গাছপালা
তেজপাতার ডালে লালটিকার বুলবুলিটা
একলা ঘুঘু, জোড়া ঘুঘু, হঠাৎ দেখা দোয়েলটা-
নিমের ডগায় নদীর প্রেম চক্রাবক্রা মাছরাঙা’

বাংলাদেশের বাস্তবতায়, করোনাকালে সমগ্র পৃথিবীর চিত্র সুনিপুণভাবে কবি তার কবিতার মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন। আজ থেকে অনেক বছর পর করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব না থাকলেও, একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের বাস্তবতায়, করোনাকালে সময়ে সমগ্র পৃথিবীর চিত্র সুনিপুণভাবে কবি তার কবিতার মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন। আজ থেকে অনেক বছর পর করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব না থাকলেও, একবিংশ শতাব্দীর এই মহামারির সঠিক চিত্র মানুষ জানতে পারবে এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণও সার্থক ও বুদ্ধিদীপ্ত। কারণ সভ্যতার চরম উন্নতির এই যুগে মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি যে- এরকম একটি মহামারি সারা বিশ্বকে একসাথে অতিদ্রুত গ্রাস করবে কিংবা দৈনিক একসাথে লাখ লাখ লোক মারা যাবে। রূপক অর্থে কবি করোনাভাইরাসকেই সন্ত্রাস হিসেবে কল্পনা করেছেন, যা মানুষের চিন্তাজগতকে আক্রমণ করেছে। এই কাব্যগ্রন্থটি কোভিড-১৯ এর সমগ্র চিত্র তুলে ধরলেও কিছু কিছু শব্দের বারংবার ব্যবহার পাঠককে কবিতার বৈচিত্র্যতার স্বাদ থেকে কিছুটা বঞ্চিত করতে পারে। তবে পাঠককে এই মহামারির নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় এই কাব্য।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন