বিজ্ঞাপন

বিজয়ের ডিসেম্বরকে ভয়ের মাস করার খেলা

October 26, 2022 | 4:08 pm

মোস্তফা কামাল

বাঙাগালির গর্বের মাস ডিসেম্বর। এবার গৌরবের মাসটিতে আতঙ্কের আগাম বার্তা। ‘ডিসেম্বর আমাদের মাস, এ মাসে বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দেয়া হবে না’- এমন ঘোষণা ক্ষমতাসীনদের। সেইসঙ্গে ‘ডিসেম্বরে খেলা হবে, খেলা হবে’ হুঙ্কার। আওয়ামী লীগের হুমকিটি এসেছে বিএনপির ডেডলাইন ধরনের আল্টিমেটামের জবাবে। ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়’- মর্মে প্রকাশ্য ঘোষণা এসেছে বিএনপির জনসভা থেকে। এমন কি ‘ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের জনসভায় খালেদা জিয়া উপস্থিত হবেন, ১১ ডিসেম্বর তারেক রহমান বাংলাদেশে আসবেন’-এমন আচানক কথা রটেছে বিএনপির মধ্য পর্যায় থেকে।

বিজ্ঞাপন

কথার কথা, মেঠো কথা –যা ই হোক এ ধরনের হুমকি-ধমকিমূলক কথা নানান প্রশ্নের সঙ্গে উত্তেজনাও তৈরি করেছে। ১০ ডিসেম্বরের আগে কি দেশে কোনো নির্বাচন আছে? অথবা বিএনপির আন্দোলনে কি এমন কোনো সাফল্য এসেছে যে, সরকারকে বিদায় নিতে হবে? দৃশ্যত তেমিন কোনো আলামত নেই। তবে, দল দুটির মধ্যে ডিসেম্বরে খেলা হবে, মানে উত্তেজনাকর কিছু হবে-সেই বার্তা পরস্কিার।

এমনিতেই সময়টা ভালো যাচ্ছে না। সরকার থেকেই দুর্ভিক্ষের শঙ্কা জানো হয়েছে। নিত্যপণ্যের উচ্চদাম মারাত্মক পর্যায়ে। বিদ্যুতের নাজুক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক গোলমাল, সামাজিক অস্থিরতাসহ মানুষ ভীষণ যন্ত্রনায়। দেশ নানান ঝুঁকি-ঝক্কিতে। তালগোল আরো অনেকদিকেই। পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা সরকারের। নানান তবে-কিন্তু-যদিযুক্ত ব্যাখ্যা থাকলেও এসব তথ্য নিয়ে দ্বিমতের কিছু নেই। এমন সময়ে বিএনপি উল্লসিত। তারা কি এমন কিছুই চেয়েছিল? এমন কিছুর অপক্ষো করেছিল। নাকি তাদের আন্দোলনের কোনো সাফল্যেই দেশে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে? নইলে তারা হাতির ৫ পা দেখছে কেন?

বিএনপি এ সময়টিকে ঝাকি দেয়ার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত মনে করে বেছে নিয়েছে কিনা- যৌক্তিক প্রশ্ন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে সরকারিভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে ত্রিশ হাজার লোক খাদ্যাভাবে মারা গেছে বলে প্রচারিত। ওই দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট বলেও দাবি আছে। ওই সময়ে বাংলাদেশকে খাদ্য না দিতে মার্কিন প্রশাসনের রাজনীতিও ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ তখন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু, ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে। কিছুটা আজকের মতো। বিশ্বে তখনও চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ। তখন নির্দিষ্টভাবে কিউবা ও উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে যেকোনো দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক করার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছিল। নতুন স্নায়ু যুদ্ধকালে তাই পুরানো স্মৃতি কেবল স্মৃতি নয়, আতঙ্কেরও। রাজনৈতিক সমস্যা জিইয়ে থাকলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরো তেজ পায়। শুরু হয়ে গেলে দুর্ভিক্ষ-দুর্বিপাক-মহামারি কখনো সরকারি দল-বিরোধী দল চেনে না। দলমত বাছে না। ছোবল মারে সবাইকে। তবে, দুর্ভিক্ষ ভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগ নয়। দুর্ভিক্ষ রোধযোগ্য। কেন দুর্ভিক্ষ হয়, হতে পারে, কিভাবে তা রোধ করা যায়- সব দৃষ্টান্তই দুনিয়াতে আছে।

বিজ্ঞাপন

দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগ-দুর্বিপাক-মহামারি কারো জন্য ভালো খবর নয়। দেশে-দেশে এসবকে ইস্যু করে মাঠ গরম করা, সরকারকে চিৎকাত করে ফেলার চর্চা রয়েছে। এসবকে ইস্যু করে সরকারের টিকে যাওয়ার নজিরও অনেক। কিন্তু, এতে সমস্যা বিদায় নেয় না। দুঃস্থ মানুষের বিপর্যয় রোধ করা যায় না। বরং আরো জটিলতা পাকে। সমস্যার রূপ বদলে নতুন নতুন আপদ চাপে। তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে বাংলাদেশ তা হাড়ে-হাড়ে ভুগেছে। এর জেরও সয়েছে। এবার কিছুটা ওই ধরনের পরিস্থিতি আঁচ করে মাঠের বিরোধীদল বিএনপির হুংকার এবং ‘লড়কে লেঙ্গে’ ভাব । টানা প্রায় ১৪ বছর ব্যাকপুটে পড়ে থাকা দলটির গত ক’দিনের তৎপরতার মধ্যে নানা মাত্রা। আবার সরকারি মহল থেকেও তীর্যক কথার অবিরাম তীর। দেখিয়ে দেয়ার কড়া হুমকিসহ ‘খেলা হবে’ মর্মে হুঙ্কার। কঠিন- সঙ্গিন এ সময়টাকে আওয়ামী লীগ বা সরকারই বা কেন খেলার জন্য পছন্দ করেছে? কোনো সুখের জেরে? নাকি ভয়ে? জিতবে কারা?-এর চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন- কী খেলা হবে? তাস, লুডু, ছক্কা-পাঞ্জা? খেলবে কারা-কারা? কতগুলো পক্ষ থাকবে ওই খেলায়?

ডেডলাইন দেয়া উৎকট গন্ধের কটকটে রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। এর পরিনতিও জানা। ২০০৪ সালের মার্চের ২১-২২ তারিখে ’৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি সরকারের পতনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। তার হাতে ট্রাম্পকার্ড আছে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু, কার্ডটির ধরন বলেননি। দল থেকেও তাকে এ ইস্যুতে তেমন গ্রাহ্য করা হয়নি। আবার একেবারে অগ্রাহ্য করাও হয়নি। এতে রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হয়েছে। প্রকাশ্যে রাজপথে বেদম পিটুনিসহ ধরপাকড় এবং অবশেষে রক্তারক্তি। এ ধারাবাহিকতায় চলতে চলতে এক সময় ওয়ান ইলেভেন। রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের খোল-নলচে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। নেই আজাবের কথা আওয়ামী লীগ-বিএনপি দল দুটির কাছে এখনো দগ-দগে ঘায়ের মতো। কেবল রাজনীতির মাঠের তাওয়া গরম করতে যদি তারা এখন ‘বিরোধী দলের সঙ্গে খেলা আর ১০ ডিসেম্বরে সরকারকে নিরুদ্দেশ’ করে ফেলার ওয়াজ ফরমান তা কারো জন্য ভালো ফল আনতে পারে না।

হতে পারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি সমাবেশে বিশাল জনসমাগম বিএনপিকে উজ্জীবিত করেছে। নিয়মিত কর্মসুচি চলছে তাদের। গরম-গরম কথা আছে প্রতিদিনই। সমাবেশগুলোতে গরম কথার খই ফুটছে। বাঁশের চেয়ে কঞ্চিদের কথার তেজ বেশি। এ ধরনের ধরনের কথা আসতে থাকলে খালেদা জিয়া এভাবে মুক্ত থাকবেন না আবার জেলখানায় পাঠানো হবে তা ভাবতে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সরকারি মহল থেকে। এটিও হতে পারে খেলার বোল দেয়া বা হুঁইসেল বাজানোর অংশ। আলামতটি ভালো নয়। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং পুলিশের গুলিতে দলের নেতা-কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সব কর্মসূচি একাই পালন করবে বিএনপি।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের পর ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সমাবেশ হয়েছে ময়মনসিংহ- খুলনায়। এর পরে হবে রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহীতে এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। সেদিনই খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলা শুরুর ঘোষণা দেয়ার কোনো এজেন্ডা ছিল না। কথা ছিল এসব কর্মসূচির ফাঁকে ফাঁকে শেষ করা হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপ। এসব সংলাপে ‘যুগপৎ আন্দোলনের’ প্রধান দাবিগুলো চূড়ান্ত করার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এরপর সরকারবিরোধী ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের সূচনা করবেন তারা। এর আগেই ১০ ডিসেম্বরে সরকারের আখেরি দিন হয়ে গেলে তো সব শেষ। আর কিছুই লাগে? রাজনীতি এতো সোজা? হিসাব মতো আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরো এক বছরেও বেশি সময়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে এমন বায়বীয় কথামালা দ্রবমূল্য, দুর্ভিক্ষের শঙ্কা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের মাঝে বাড়তি কোনো বিপদকে আমন্ত্রণ জানানও নয় তো?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন