বিজ্ঞাপন

লাখ টাকায় রোহিঙ্গা হয়ে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশি’

October 26, 2022 | 6:13 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশজুড়ে নির্বাচন কমিশনের চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম নগরীতে বড়ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এক লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভোটার করার পাশাপাশি এনআইডি পাইয়ে দিচ্ছে একটি চক্র। এই চক্রে আছে অস্থায়ী ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ করা একদল ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, নির্বাচন কমিশন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মী এবং কক্সবাজারের কয়েকজন ব্যক্তি।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশি’ বানিয়ে এনআইডি পাইয়ে দিতে প্রতিজনের কাছ থেকে অপারেটররা নিচ্ছেন নয় হাজার টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের জাল জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় এনআইডি পেয়ে একজন রোহিঙ্গা হয়ে যাচ্ছেন ‘বাংলাদেশি’।

মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক অভিযানে পাঁচজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও দু’জন রোহিঙ্গাসহ মোট ১০ জন গ্রেফতার হওয়ার পর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

এর আগে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও এনআইডি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে প্রথম জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন হয়। ২০১৪ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রমজান বিবি নামে এক নারী ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে তৈরি করেন জাল এনআইডি। স্মার্ট কার্ড নিতে চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে সন্দেহবশত তাকে জেরা করা হয়। দেখা যায়, তার জন্মসনদ জাল। অথচ সেই জন্মসনদ ব্যবহার করে তৈরি করা পরিচয়পত্রের তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনার পর নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন, এনআইডি উইংয়ের কর্মী শাহনূর মিয়া, অস্থায়ী কর্মী মোস্তফা ফারুক, মো. শাহীন, মো. জাহিদ হাসান এবং পাভেল বড়ুয়াসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়।

জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করে। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে প্রকাশ হয়, ইসি’র হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২১০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হয়। এদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা। দুদক ১১ জনের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করেছিল, যে মামলায় চট্টগ্রাম জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম, অফিস সহায়ক রাসেল বড়ুয়া এবং টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তাফা ফারুককে আসামি করা হয়েছিল।

ইসি, পুলিশ ও দুদকের মামলাগুলো ‘হিমাগারে’ থাকার মধ্যেই তিন বছর পর আরেকটি জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন হয়েছে। তবে এবার গোপনে ইসি’র ল্যাপটপ ব্যবহার করে তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা ভোটার করা ও এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এবার সরাসরি ইসি’র চলমান কার্যক্রমের আওতায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হচ্ছে এবং এনআইডি পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

গ্রেফতার পাঁচজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হলেন- ইয়াছিন আরাফাত (২২), নূর নবী (২৫), মিজানুর রহমান (২৩), ফরহাদুল ইসলাম (২৮) ও ইমন দাশ (২০)। এদের সঙ্গে গ্রেফতার আরও পাঁচজন হলেন- নুরুল আবছার (২৮), শামসুর রহমান (৬০) ও মো. কামাল (৪৯) এবং দুই রোহিঙ্গা কামাল হোসেন (৪৫) ও পারভীন আক্তার (২৫)।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার (ডিবি-বন্দর) মুহাম্মদ আলী হোসেন সারাবাংলাকে জানান, মঙ্গলবার সকালে নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকার বি-ব্লকে হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চ বিদ্যালয়ে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলছিল। গোপন সূত্রে ডিবি জানতে পারে, সেখানে কক্সবাজার থেকে দু’জন রোহিঙ্গা ভোটার হতে এসেছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা কামাল ও পারভীনকে আটক করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, শামসুর রহমান ও নুরুল আবছার তাদের ভোটার করার জন্য হালিশহরে এনেছেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর বহদ্দারহাটে তাদের অবস্থান শনাক্ত করে দু’জনকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও মোবাইলে থাকা তথ্য যাচাইবাছাই করে পাঁচজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে আটক করা হয়। কামাল নামে এক অটোরিকশা চালক রোহিঙ্গা দু’জনকে হালিশহরে নিয়ে যান, তাকেও আটক করা হয়।

শামসুর রহমান কক্সবাজারের পোকখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতি সংক্রান্তে তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারে দুটি ও চট্টগ্রামে দুদকের দায়ের করা একটি মামলা আছে। এ কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন। জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশি বানানোর জন্য শামসুর রহমান ও নুরুল আবছার রোহিঙ্গাদের কাছে খুবই বিশ্বস্ত বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান। এছাড়া আটক কামাল হোসেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। পারভীন নামে বাংলাদেশি একজনকে বিয়ে করে থাকেন কক্সবাজারের ঈদগাহ এলাকায়।

বিজ্ঞাপন

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলী হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শামসুর ও আবছারের সঙ্গে চট্টগ্রামে ইসি’র চলমান প্রকল্পে যুক্ত আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা কয়েকজন কর্মচারীর যোগাযোগ আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা এবং ঢাকার নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের যোগসাজশের তথ্য পেয়েছি। তবে সেটা আমরা আরও যাচাই-বাছাই করছি। নির্বাচন কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মীর নামও পেয়েছি, তবে আমরা নিশ্চিত নই যে তারা জড়িত।’

‘শামসুর ও আবছার মিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে বাংলাদেশি এনআইডি পেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করেন। এরপর তাদের নিয়ে আসেন চট্টগ্রামে। কক্সবাজারে সাধারণত তারা এই কাজ করে না, কারণ সেখানে এনআইডি পেতে অনেক বেশি তথ্য দিতে হয় ও যাচাই-বাছাই করা হয়। তারা প্রতিজনের কাছ থেকে নেন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তার মোবাইলে রোহিঙ্গার নাম, পিতার নাম ও মাতার নাম পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে আধাঘণ্টার মধ্যে জন্ম নিবন্ধন সনদ চলে আসে। ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের সঙ্গে কথামতো রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তারা চলে যান সেখান থেকে। অপারেটরদের প্রত্যেকের জন্য দেন নয় হাজার টাকা করে।’

আবছারের মোবাইলে ৫০০ রোহিঙ্গার জন্ম নিবন্ধন সনদের ছবি পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসি থেকে জন্ম নিবন্ধন সনদ বের করছে। অথচ ঠিকানা ব্যবহার করা হচ্ছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার। সেই জন্ম নিবন্ধন সনদ অপারেটরদের কাছে দেওয়ার পর তারা আঙুলের ছাপ নেয় ও ছবি তোলে। এর পর নূরনবী নির্বাচন কমিশনের মূল সার্ভারে সেসব তথ্য আপলোড করে। এভাবে একদম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা পাচ্ছে এনআইডি, হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিক।’

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) শামীম কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই কাজে শুধু কয়েকজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর জড়িত এমন নয়। আমরা নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েরও কয়েকজনের নাম পেয়েছি, যারা সার্ভারে তথ্য ইনপুট দেন। সেটা আমরা যাচাইবাছাই করে দেখছি। রোহিঙ্গাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের একটি নিবন্ধন ফরম পাওয়া গেছে। সাধারণত এই ফরম নির্বাচন কর্মকর্তা ছাড়া আর কারও কাছে পাওয়ার কথা নয়। আমরা তথ্য পেয়েছি, সাদ্দাম নামে একজন এই ফরম আবছারকে দিয়েছে। সাদ্দাম হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে কর্মরত আছেন বলে জানতে পেরেছি।’

ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের আরও বিভিন্নস্থানে এই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো হচ্ছে বলে সন্দেহ ডিবি কর্মকর্তাদের। আটক ১০ জনের বিরুদ্ধে এনআইডি নিবন্ধন আইনে ও দুই রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৈদেশিক নাগরিক আইনে নগরীর হালিশহর থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান ডিবি কর্মকর্তা শামীম কবীর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার কাজ চলছে। কয়েকজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে শুধু এই প্রকল্পের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের সঙ্গে আমাদের কার্যালয়ের কেউ জড়িত আছে কি না সেটাও ডিবিও তদন্ত করছে, আমরাও যাচাই-বাছাই করছি। তদন্তে যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়, আমরা ব্যবস্থা নেব।’ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ফরমটি চট্টগ্রামের সিরিয়াল নম্বরের নয় বলে দাবি হাসানুজ্জামানের।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের মে মাস থেকে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার কাজ শুরু করে।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন