বিজ্ঞাপন

ভয়াল ২৯ এপ্রিল: এখনও কাঁদেন ৩ সন্তানহারা ছকিনা

April 29, 2018 | 11:09 am

।। ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার :  আজ থেকে ২৭ বছর আগে ‘১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সোমবারে প্রতিদিনের মতো আমার তিন সন্তানের মধ্যে হ্যাপি (৫) আর মোহাম্মদ হেলাল (৮) বাড়ির উঠানে খেলছিল। আর ৮ মাসের হালিমা ছিল কোলে। সেদিন সকাল থেকে হ্যাপি আর হেলাল খুব ছুটোছুটি করছিল। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে হ্যাপি খেলছিল আমার লাল ওড়না নিয়ে। আর মোহাম্মদ হেলাল দৌড়ঝাঁপ করছিল। বাচ্চাদের এই দৃশ্য দেখে খুব ভাল লাগছিল। আবার কেন জানি ভয়ও হচ্ছিল।’

‘প্রকৃতির কি খেলাঠিকই সেই রাতের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়েছি প্রাণ প্রিয় তিন সন্তানকে। আমি এখনও ভুলতে পারি না আমার সন্তান হারানোর সেই মুহূর্তগুলো। মন চায় চিৎকার করে কান্না করি। তখন আর কিছুই ভালো লাগে না।’ এ সব কথা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল কক্সবাজারের শহরের কুতুবদিয়া পাড়ার ছকিনা বেগমের (৪৮)।

ছকিনা দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের লামার বাজারের নুরুল ইসলামের স্ত্রী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তিন সন্তানসহ পরিবারের ১২ সদস্য ও ভিটে-বাড়ি হারিয়ে কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। ওই পাড়ার বেশিরভাগ লোক’ই ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত কুতুবদিয়ার বাসিন্দা। তাই এলাকাটির নামও কুতুবদিয়া পাড়া।

বিজ্ঞাপন

ভয়ঙ্কর সেই রাতে সন্তান হারানোর ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে ছকিনা বেগম বলেন, ‘ওইদিন দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে বাতাস শুরু হয়। রাতে চলে প্রবল ঝড় আর বাতাস। ওই সময় আমার স্বামী ছিল পাশের গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। অবস্থা দেখতে বাইরে আসতেই দেখা যায় উঠানে পানি। আর মুহুর্তের মধ্যে ওই পানি কোমর পর্যন্ত। সঙ্গে ছিল প্রচণ্ড স্রোত। তখন বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের গুদামে উঠে যাই। গুদামে উঠার একটু পরেই ওখানে পানি উঠে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই বড় বড় ঢেউ ধাক্কা দিচ্ছিল গুদামে। আর একটু পরেই সব লণ্ডভণ্ড। কখন যে ৮ মাসের হালিমা বুক থেকে চলে গেছে জানি না। হ্যাপি ছিল তার দাদির হাতে। হেলাল ছিল আমার হাতে। আমরা মা-ছেলে যখন ভেসে যাচ্ছিল। তখন আমার সন্তান বার বার বলছিল মা আমি পানি খাচ্ছি আমাকে বাঁচাও। কিন্তু শত শক্তি দিয়েও আমার ছেলেকে উপরে উঠাতে পারছিলাম না। তার মধ্যে চারদিকে ছিল অন্ধকার এরই মধ্যে চিৎকার শুনতে পাই আমার মেয়ে হ্যাপির। তার দাদি তাকে নিয়ে একটা উঁচু গাছে উঠে ছিল। হেলালকে নিয়ে কোনোভাবে সেই গাছ পর্যন্ত যাওয়ার গেলেও গাছের উপরে থাকা লোকজনগুলো আমাদের টেনে তোলেনি। এরই মধ্যে হেলারও আমার হাত থেকে ছুটে যায়। আর আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম পানির নিচে। এরপর আর কিছুই জানি না।’

 ‘পরদিন সকালে আমার জ্ঞান ফিরে আমি একটি গাছের ফাঁকে আটকা অবস্থায়। পরে লোকজন আমাকে গায়ে কাপড় পরিয়ে দেয়। এরই মধ্যে সব শেষ হয়ে গেছে আমার। আমি নিজেই বুঝতে করতে পারছিলাম না আমার ঘরটি কোথায় ছিল। কারণ চারদিকে থৈ থৈ পানি। আর ওখানো ভাসছে লাশ আর লাশ। পশু আর মানুষের লাশ হয়েছিল একাকার। পাগলের মত হন্ন হয়ে খোঁজছিলাম সন্তানদের। একটু দুরেই পেলাম সেই লাল ওড়না প্যাচানো হ্যাপির লাশ।’

বিজ্ঞাপন

ছকিনা বলেন, ‘খুঁজে পাইনি আমার বাকি দুই সন্তানের লাশ। একদিন পর স্বামী আমাকে খুঁজে পাই। জানতে পারি, আমার তিন সন্তানসহ ১২ আত্মীয় মারা যান এই ঘূর্ণিঝড়ে।’ এ সব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছকিনা বেগম।

এ গল্প একজন ছকিনা বেগমের। কিন্তু হাজার হাজার ছকিনার রয়েছে এর চেয়ে ভয়াবহ গল্প। কক্সবাজারের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবর্তী এলাকায় এমনও পরিবার রয়েছে যাদের একজনও বেঁচে নেই। কারো কারো পুরো একটি গোষ্টির মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র একজন।

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকুলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সরকারি হিসাবে অনুযায়ী দেড় লাখ লোক মারা যাওয়ার কথা বললেও এই সংখ্যা ২ লাখের বেশি। এছাড়া মারা যায় ৩০ হাজারের বেশি গবাদি পশু। গৃহহারা হয় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।

এ সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। রাতের আঘারে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ে গাছের ডালে, ঘরের চালে, খাল-বিল, নদী-সাগরে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। পশু আর মানুষের লাশ একাকার হয়ে গিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রসঙ্গে কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরং এর চেয়ারম্যান আ ক ম শাহরিয়ার জানান, কুতুবদিয়ায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ দরকার। সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবছর বেড়িবাঁধ করা হয় আর প্রতিবছরই নষ্ট হয়। এই বেড়িবাঁধ নিয়ে চলে দুর্নীতি। এতে সরকারের টাকাও নষ্ট হয় কাজের কাজও কিছুই হয় না। তাই তাদের প্রত্যাশা একটি স্থায়ী বেড়িবাঁধ।

বান্দরবান জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রাকিবুল হাসান জানান, কুতুবদিয়ায় ১৩৭ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। এতে নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৯৭ কোটি টাকা ও ঠিকাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৪০ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ। মোট সাড়ে ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মিত হবে। এতে সাড়ে ৪ কিলোমিটার হবে সিসি ব্লক দিয়ে আর ৯ কিলোমিটার হবে মাটির কাজ।

এরইমধ্যে ইতোমধ্যে সিসি ব্লকের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। মাটির কাজ হয়েছে দুই কিলোমিটার। তবে আসন্ন বর্ষায় যাতে কোনো গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

সারাবাংলা/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন