বিজ্ঞাপন

আয়াতের শরীরের ‘খণ্ডিত অংশগুলোর’ সন্ধানে ফের তল্লাশি

November 27, 2022 | 6:54 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে শিশু আলীনা ইসলাম আয়াতকে খুনের পর কেটে সাগরে ভাসানো শরীরের টুকরোগুলোর সন্ধানে ফের তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) টিম। সঙ্গে ছিল রিমান্ডে থাকা আসামি আবির আলী। এছাড়া তাকে নিয়ে তার মায়ের বাসায়ও তল্লাশি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গ্রেফতারের পর আবির আলী দাবি করেছিল, আয়াতের লাশের ছয় টুকরোর মধ্যে প্যাকেটবন্দি তিন টুকরো নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে বেড়িবাঁধের পর আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বাকি তিন টুকরো একইভাবে আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে একটি নালায় স্লুইচগেটের প্রবেশমুখে ফেলে দেয় আবির।

রোববার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে আবির আলীকে নিয়ে পিবিআই টিম যখন সেই স্থানগুলোতে যায়, তখন আয়াতের বাবাসহ স্বজনরা দেখে সেখানে বুক চাপড়ে আহাজারি শুরু করেন। স্থানীয় কয়েক’শ লোক জড়ো হয়ে আবিরের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

আয়াতের বাবা সোহেল রানা কান্নায় ভেঙে পড়ে রাস্তায় বসে যান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সে (আবির) মিথ্যা কথা বলছে। তাকে রিমান্ডে নিলে সে আমার মেয়ের লাশ কোথায় ফেলেছে দেখিয়ে দেবে। আমার মেয়েটার কি অপরাধ ছিল? কেন তার লাশ পাচ্ছি না। কোথায় লাশ? কিছু আলামত পেলে মনকে বোঝাতে পারতাম।’

আয়াতের দাদা মনজুর আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তার (আবির) মা আর বোন সব জানে। সেই বাসায় একটা মানুষকে সে কেটে রেখে দিল আর তার মা-বোন জানবে না, এটি হয় না। পুলিশ তার মা-বোনকে গ্রেফতার করছে না কেন? সঠিক তথ্য কেন বের করা হচ্ছে না?’

বিজ্ঞাপন

আয়াতের বাবা-নানার আহাজারিতে সমবেত লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তাদের শান্ত করেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। তিনি স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, ‘আবির যে আপনাদের বাসা থেকে কালো ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে, সেটি তো আপনারা দেখেছেন। তাহলে ঘটনার পর তাকে আপনারা কিছু জিজ্ঞেস করেননি কেন? আপনারা তো তাকে সন্দেহের কথাও আমাদের বলেননি। আমরা বিভিন্নভাবে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়ে সে যেখানে লাশের টুকরাগুলো ফেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে, সেখানে আমরা গত চারদিন ধরে কয়েকবার তল্লাশি করেছি। এখনও করছি। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু সেগুলো পাচ্ছি না। এখন আপনারা যদি আমাদের দোষারোপ করেন, তাহলে তো হবে না।’

জবাবে আয়াতের দাদা বলেন, ‘সে যে এত বড় ঘটনা করবে, বস্তায় ভরে লাশ নিয়ে যাবে, সেটি আমরা কোনোদিন কল্পনা করিনি। লাশের কিছু একটা পেলে মনকে বোঝাতে পারতাম। একটা হাত, পা, একটা জামা পেলেও মনকে বোঝাতে পারতাম। কিছুই পাচ্ছি না।’

পিবিআই এসপি নাইমা সুলতানা তাদের বলেন, ‘আবির যে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করত, সেটি তো আপনারা দেখতেন, জানতেন। আপনারা তাকে সেটা করতে দিলেন কেন? কার মনে কী আছে, আপনারা কি জানতেন? সে যতটুকু তথ্য আমাদের দিয়েছে আমরা সেই অনুসারে আগাচ্ছি। আমরা চাই, একটা রেজাল্ট আসুক। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন।’

বিজ্ঞাপন

রোববার দুপুরে পিবিআই টিমের সদস্যরা বে-টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে সাগরতীরে পানি ও কাদার মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা তল্লাশি করেন। কিন্তু আবিরের দাবিমতো, শরীরের খণ্ডিত কোনো অংশ পাওয়া যায়নি। এর আগে নগরীর ইপিজেড থানার পকেটগেট বাজার এলাকায় আবিরের মায়ের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে একটি ডায়েরি উদ্ধার করে পিবিআই টিম।

জানতে চাইলে আয়াত খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক (মেট্রো) মনোজ কুমার দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবির আলীকে রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদে সে আবারও একই দাবি করেছ যে, লাশ কেটে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আবারও ঘটনাস্থল চিনিয়ে দিতে বলা হলে সে রাজি হয়। তখন আমরা তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসি এবং তার দেখানোমতে আবার তল্লাশি করি, যদিও গ্রেফতারের পর এবং রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সে একই স্থানের কথা উল্লেখ করেছে।’

‘আমরা তল্লাশিতে কোনো দেহাবশেষ পাইনি। তবে তার মায়ের বাসায় তল্লাশি করে একটি ডায়েরি পেয়েছি। সেই ডায়েরিতে আবিরের উচ্চবিত্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা লেখা আছে। তবে সেগুলো তার হাতের রেখা কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে’- বলেন পিবিআই পরিদর্শক মনোজ

আবির আলী (১৯) নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা আজহারুল ইসলামের ছেলে। তাদের বাড়ি রংপুর জেলায়। শিশু আয়াতকে খুনের মামলায় তার সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পাবার পর গত ২৪ নভেম্বর রাতে তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই। ২৬ নভেম্বর তাকে আদালতে হাজির করে ওই মামলায় দশদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গত ১৫ নভেম্বর বিকেলে নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার মেয়ে চার বছর ১১ মাস বয়সী আলীনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হন। ১০ দিন পর আবির আলীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নিখোঁজ রহস্যের উদঘাটন হওয়ার কথা জানায় পিবিআই। এ ঘটনায় আয়াতের বাবা বাদি হয়ে নগরীর ইপিজেড থানায় মামলা দায়ের করেন।

পিবিআইয়ের ভাষ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আজহারুলের ছেলে আবির আলী। পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ আবিরকে আয়াত ‘চাচ্চু’ বলে সম্বোধন করত। ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসার সামনে থেকে আয়াতকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আবির ঢুকে যায় তার বাবার বাসায়, যেখানে তখন কেউ ছিল না। সেখানে ১৫ মিনিটের মধ্যে শ্বাসরোধ করে আয়াতকে খুন করে আবির।

এরপর লাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে যায় নগরীর আকমল আলী সড়কের পকেটগেট বাজার এলাকায় তার মা আলো বেগমের বাসায়। মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের পর আবির মায়ের বাসায় থাকত। তবে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা যে এলাকায়, সেই বাবার বাসায়ও তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আবির মায়ের বাসায় নিয়ে লাশ বাথরুমের তাকের ওপর লুকিয়ে রাখে। রাতে সেই লাশ বাথরুমে নিয়ে কেটে ছয় টুকরো করে ছয়টি ব্যাগে ভরে রাখে।

পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরো নগরীর আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে বেড়িবাঁধের পর আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওইদিন রাতে বাকি তিন টুকরো আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে একটি নালায় স্লুইচগেটের প্রবেশমুখে ফেলে দেয় আবির।

কিন্তু মুক্তিপণ আদায়ের জন্য সংগ্রহ করা সীম ব্লক থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আবির। আয়াতের খেলার সাথীদের কাছ থেকে তাকে কোলে নেওয়ার তথ্য এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আবিরের গতিবিধি দেখে তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই। গ্রেফতারের পর লাশের টুকরো ফেলে দেওয়ার স্থানগুলো সরেজমিনে পিবিআই কর্মকর্তাদের দেখিয়ে দেয় আবির আলী।

আরও পড়ুন
আয়াতের মৃত্যু এবং আমাদের নষ্ট সমাজ
শিশুকে ৬ খণ্ড করে সাগরে ভাসাল ‘ক্রাইম পেট্রল’ আসক্ত তরুণ
শিশু আয়াতকে হত্যার পর বীভৎসতার প্রতিবাদ খেলাঘরের
শিশুকে খুনের পর লাশ ছয় খণ্ড: গ্রেফতার তরুণ রিমান্ডে

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন