বিজ্ঞাপন

স্কুলের রি-অ্যাডমিশন ফি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় অভিভাবকরা

November 28, 2022 | 9:31 am

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনা মহামারির উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুনঃভর্তি ফি নেওয়া যাবে না মর্মে ২০২০ সালের নভেম্বর এবং ২০২১ সালের শেষ দিকে সার্কুলার জারি করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল— শিক্ষার্থীদের পুনঃভর্তির ক্ষেত্রে মোট ৭টি খাত— অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি গ্রহণ করতে পারবে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাউশির এ নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে বিদায়ী বছরের শুরুতে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রছাত্রীদের পুনঃভর্তির ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর সমান ফি গ্রহণ করে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিছুটা ‘কূট’ কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা।

বিজ্ঞাপন

বছরের শুরুতে শিক্ষার্থী পুনঃভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন না করেই বই বিতরণসহ অন্যান্য কাজ চালিয়ে নেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি পুনঃভর্তি এবং জানুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধের আগেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে শুরু করে স্কুলগুলো। পরে অবশ্য শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অভিভাবকদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়— জানুয়ারি মাসের মধ্যেই স্কুলের সমূদয় পাওনা পরিশোধ করার।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে— প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন ফি নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আংশিক মানছে। তবে টিফিন ও পুনঃভর্তি ফি না নিলেও অন্তত ২০/২৫টি খাতে ফি আদায় করছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এই খাতগুলোর সাথে সমন্বয় করে নিচ্ছে পুনঃভর্তি ফি।

রাজধানীর আজিমপুরের ‘অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজ’ ২০২২ শিক্ষা বর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পুনঃভর্তির সময় জানুয়ারি মাসের বেতন বাবদ ৭০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ৫৫০ টাকা, খেলাধুলা ৪০০ টাকা, ভবন নির্মাণ ৫০০ টাকা, সংস্কার ৪০০ টাকা, মুদ্রণ ৫০০ টাকা, আইসিটি সেবা ৮২০ টাকা, পাঠাগার ২০০ টাকা, নবীনবরণ ২০০ টাকা, জলকর ২০০ টাকা, মিলাদ ১৫০ টাকা, কল্যাণ ফান্ড ৫০০ টাকা, গ্র্যাচুইটি ৫০০ টাকা, গবেষণাগার ১০০ টাকা, ম্যাগাজিন ১০০ টাকা, দরিদ্র তহবিল ৩০০ টাকা, কম্পিউটার ল্যাব ২০০ টাকা, যোগাযোগ প্রযুক্তি ২২০ টাকা, রেডক্রিসেন্ট ফি ২০, বিবিধ ১০০ টাকাসহ মোট ৬ হাজার ৬৬০ টাকা করে প্রত্যেক ছাত্রীর কাছ থেকে আদায় করে।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া প্রতি মাসে ৭০০ টাকা করে বেতন ও বার্ষিক পরীক্ষার ফি বাবদ আরও ৭০০ টাকাসহ বিদায়ী বছরে ১৫ হাজার ৪৬০ টাকা করে নিয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির একেকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে উপরে উল্লেখিত হারে পুনঃভর্তি ফি নেওয়া হলেও উপরের শ্রেণিগুলোতে ফি’র পরিমাণ আরও বেশি। অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।

গত এক সপ্তায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গেটে শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষায় থাকা অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা প্রত্যেকেই রি-অ্যাডমিশন ফি’র নামে ‘অদ্ভূতুরে’ খাতে মোটা অংকের টাকা দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তারা দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, উচ্চমূল্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল পরিশোধ এবং বর্ধিত হারে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করার পর সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অধিকন্তু অযৌক্তিক খাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ফি আদায় মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে তাদের জন্য।

বিশেষ করে রাজধানীর ‘তথাকথিত’ খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। অপেক্ষাকৃত কম নাম-ডাক ওয়ালা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘অনৈতিক ফি’ আদায় নিয়ে উচ্চবাচ্য করা গেলেও নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পান না অভিভাবকরা।

বিজ্ঞাপন

এসব নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। রাজধানীর বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরা ক্যাম্পাস মিলিয়ে প্রায় ২৯ হাজার ছাত্রী রয়েছে। ঢাকার আরেকটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। রাজধানীর মতিঝিল ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদা ক্যাম্পাস মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

জানা গেছে, এ দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকা রি-অ্যাডমিশন ফি আদায় করে কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকরাও সন্তানের ছাত্রত্বের ঝুঁকি এড়াতে বিনা বাক্য ব্যয়ে মুখ বুঝে ‘অদ্ভূতুরে’ খাতে রি-অ্যাডমিশন ফি দিয়ে থাকেন।

মতিঝিল আইডিয়ালের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এস এম গোলাম সামদানী ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর রি-অ্যাডমিশন ফি’র নামে প্রায় ২০/২৫ খাতে টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে কেবল জেনারেটর ফি বাবদই পরিশোধ করতে হয় ২৫০০ টাকা। অথচ আমি এই স্কুলে কোনো দিন জেনারেটর চালাতে দেখি নাই।’

আজিমপুর অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজের এক ছাত্রীর অভিভাবক মো. আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইসিটি সেবা বাবদ ৮২০ টাকা নেওয়ার পর যোগাযোগ প্রযুক্তি ফি বাবদ ২২০ টাকা নেওয়ার যুক্তিটা কী— তা আমি বুঝতে পারিনি। আবার কল্যাণ ফান্ডে ৫০০ টাকা নেওয়ার পর দরিদ্র ফান্ডে কেন ৩০০ টাকা দিতে হবে, সেটারও কোনো মানে খুঁজে পাই না। তাছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া একটা বাচ্চার জন্য কম্পিউটার ল্যাব, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, জলকর খাত নামক ‘অদ্ভূতুরে’ খাতে কেন টাকা আদায় করা হয়— এর কোনো উত্তর আমরা খুঁজে পাই না।’

বিজ্ঞাপন

এসব খাতে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রেজাউজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাউশির দিক-নির্দেশনা মেনে স্কুল পরিচালনা কমিটি যে ফি নির্ধারণ করে, আমরা সেটাই আদায় করি। আর আপনি যদি আশ-পাশের স্কুলগুলোর সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন অন্য যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আমরা কম খরচে পড়াই। আমাদের এখানে ছাত্রীদের লেখা-পড়ার খরচ অনেক কম।’

ভিকারুন নিসা বা মতিঝিল আইডিয়ালের মতো মিরপুরের মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও রি-অ্যাডমিশনেও মোটা অংকের ফি গুণতে হয়। এখানে সবকিছু মিলিয়ে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা লাগে। শেওড়াপাড়া শাখার অভিভাবক সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, বিদায়ী বছরে তার মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। ভর্তি ফি বাবদ আট হাজার টাকা, জানুয়ারির বেতন দেড় হাজার টাকা ও অন্যান্য ফি বাবদ আরও ৫০০ টাকা দিতে হয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যে ফের রি-অ্যাডমিশন ফি দিতে হবে তাকে।

রাজধানীর নামকরা স্কুলগুলোর মধ্যে মোহম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ অন্যতম। অভিভাবকদের কাছ থেকে ‘অদ্ভূতুরে’ খাতে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে স্কুলটির জুরি মেলা ভার। বাংলা মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সনে প্রথম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী ভর্তিতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা নিয়ে থাকে স্কুলটি। রি-অ্যাডমিশন ফি’র ক্ষেত্রে তাদের কাছে কোনো ছাড় মেলে না। বিদায়ী বছরটিতে মাউশির নির্দেশনা অমান্য করে দ্বিতীয় শ্রেণির একেকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার করে টাকা নিয়েছে। প্রতি মাসে বেতন নিয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে।

অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে টিউশন ফি আরও ১০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে মোহম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ। এবারের রি-অ্যাডমিশন ফি বা সেশন চার্জের সঙ্গে এই ১০ শতাংশ যোগ হবে।

মোহম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজের একজন শিক্ষার্থী অভিভাবক মো. শাহজাহান মোল্লা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাউশির নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও বিদায়ী বছরে রি-অ্যাডমিশন ফি বাবদ ৮ হাজার টাকা নিয়েছে। আরও দশ শতাংশ বাড়ানো হবে বলে কয়েক মাস আগে নোটিশ দিয়েছে। খরচের বিষয়টি দিন দিন আমাদের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে।’

অভিভাবকরা বলছেন, বিদায়ী বছরে সাতটি খাতে অর্থ আদায় করা যাবে না বলে সার্কুলার জারি করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। কিন্তু দেদারসে অর্থ আদায় চললেও কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ন্যুনতম ব্যবস্থা নেয়নি মাউশি। কোন খাতে কত টাকা নেওয়া যাবে, সেটিও কখনো নির্ধারণ করে দেয় না মাউশি। ফলে যার যেমন খুশি তেমন হারে অর্থ আদায় করে। কোন শ্রেণিতে ভর্তি ফি কত আর পুনঃভর্তি ফিই বা কত, সে ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা নেই মাউশির। আর থাকলেও সেটা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জানানো হয় না। ফলে ফি আদায়ের ক্ষেত্রে ‘রামরাজত্ব’ খুলে বসে আছে রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদকে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। শিক্ষা সচিবকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/এজেড/রমু

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন