বিজ্ঞাপন

শত্রুমুক্ত যশোরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা

December 11, 2022 | 8:45 pm

তহীদ মনি

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত যশোরে হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম জনসভা। সেই জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে ৪টি দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেগুলি হলো জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম। যশোর টাউন হল মাঠের (সে সময় যার আরও একটি নাম ছিল মুন্সি মেহের উল্লাহ ময়দান) মঞ্চ থেকে সে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এই জনসভার স্মরণে পরবর্তীতে মঞ্চটির নাম হয় স্বাধীনতা উন্মুক্ত মঞ্চ। ১১ ডিসেম্বর তাই বাঙালি জাতির একটি স্মরণীয় দিন। আর যশোরবাসীর জন্যে এ দিনটি গৌরব ও অহংকারের। সময়ের ব্যবধানে ও বয়সের কারণে সে দিনের অনেক কথাই মনে করতে পারেন না সে সময় যে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। তবে মূল কথাগুলো সবাই একই রকম জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে শত্রু সেনারা যশোর ছেড়ে যেতে শুরু করে। একাত্তরের ডিসেম্বরে ১৬ দিন ধরে চলা ভয়াবহ এক যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয়েছিল যশোর জেলা। যশোর সেনা ছাউনি বা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে তারা পালিয়ে যশোর-খুলনা মহাসড়ক ধরে খুলনা অভিমুখি যায়। এদিন বিকেলে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সেনানিবাসে প্রবেশ করে দখল নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার ঢল নামে শহরে। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ সন্ধ্যার পরপরই দেখতে পান যশোর শহর শত্রুমুক্ত হয়ে গেছে। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে ওই রাতেই বিজয় মিছিল করেন। ৭ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে খবর রটে যায়। আশপাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকেন শহরে। সাধারণ মানুষ ভাঙ্গা-পোড়া ঘড়-বাড়ি ছেড়ে বাইরে আসতে থাকেন।

৭ ডিসেম্বর ভোরে ৮ নাম্বার সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর মিত্র বাহিনীর নবম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিংসহ যশোরে প্রবেশ করেন। ওই দিনই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থাকা প্রবাসী সরকার ঝিনাইদহের এসডিও ওয়ালিউল ইসলামকে যশোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

বিজ্ঞাপন

পরে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম জিকু, শাহ হাদীউজ্জামান, অশোক রায় ও নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাসিলা সীমান্ত দিয়ে যশোর শহরে পৌঁছান। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

পরদিন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনের অন্যদের সাথে বেঠকে ঠিক হয় ১১ তারিখে প্রবাসী সরকারের জনসভা হবে শত্রুমুক্ত স্বাধীন দেশে এবং যশোরেই। মূলত জেলা প্রশাসক ওয়ালি উল ইসলামের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় প্রশাসনিক কাজ করার। এরপর ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে যশোরে আসেন।

আর মুক্তিযোদ্ধা-মুজিব বাহিনীর এ অঞ্চলের কমান্ডার আলী হেসেন মনি, বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব প্রাপ্ত কমান্ডার ও ডেপুটি যেমন সাবেক সাংসদ টিপু সুলতান, সাবেক সাংসাদ আব্দুল হাই, রাজেক আহমেদ, খয়রাত হোসেন, রবিউল আলম, জালাল উদ্দিন রতন, শেখ আব্দুস সালাম, খড়কির একরাম হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয় যতটুকু সম্ভব অন্যদেরকে একত্রিত করে জনসভা সফল করার। এর মধ্যে আলী হেসেন মনি, রবিউল আলম ও খয়রাত হোসেন ছাড়া প্রায় সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। যদিও কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা এ ব্যপারে এক মত হতে পারেননি। তাছাড়া উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবীর, মোহাম্মদ আলী স্বপন। যাই হোক সাধারণ মানুষের স্বত:স্ফ’র্ত অংশ গ্রহণে ১১ ডিসেম্বর বিকেলে যশোর মুন্সি মেহের উল্লাহ ময়দানে জনসভা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

যশোর টাউন হল ময়দানে অনুষ্ঠিত মুক্ত বাংলার প্রথম এ জনসভায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমবেত জনতার উদ্দেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়। এই মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’ সেদিন তিনি সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এমএলএ (গণপরিষদ সদস্য) ফণিভূষণ মজুমদার, মরহুম রওশন আলী, মরহুম আবুল ইসলাম, মরহুম মোশাররফ হোসেন, মরহুম তবিবর রহমান সরদার, সোহরাব হোসেন (মাগুরার এমএলএ) এম আর আকতার মুকুল, সাংবাদিক জহির রায়হান, আব্দুল হামিদ রায়হান প্রমুখ। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যশোরের তৎকালীন ডিসি ওয়ালি উল ইসলাম এবং কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাঞ্চন ঘোষালকে নির্দেশ দেন, আইনশৃঙ্খলায় যেন কোনো অবনতি না হয়। একই সঙ্গে জনতাকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জনসভা থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাতিল করে ৪টি দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন এই দেশে ধর্ম নিয়ে আর রাজনীতি চলবে না। আর তাই জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো’।

সেদিন মুক্ত স্বদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এ জনসভার খবর সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার গিল, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি এসএইচ সানবার্গ, ওয়াশিংটন পোস্ট’র প্রতিনিধিসহ বহু বিদেশি সাংবাদিক।

বিজ্ঞাপন

সেদিন সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধের মণিরামপুর অংশের কমান্ডার খয়রাত হেসেন উপস্থিত ছিলেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তিনি এ দিনটির সঠিক ইতিহাস এখনো সবাই এক জায়গায় বসে ঠিকভাবে উত্থাপন না করা নানা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, সুস্থ হয়ে ফিরে এসে ‘মনি ভাই(আলী হোসেন মনি) ও রবিউল আলমকে নিয়ে’ একসাথে বসবেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘সময় ও বয়সের কারণে আমরা অনেকেই অনেক কিছু গুছিয়ে বলতে হয়তো পারছি না, এক জায়গায় বসলে সবার মতামতে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) ডেপুটি প্রধান রবিউল আলম ওই সমাবেশে ছিলেন। তিনি জানান, ‘ওই সময় অগোছানো অবস্থায় ছিল সব। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর মধ্যে যশোর ও অশেপাশের এলাকার মানুষ নিয়ে ওই জনসভা হয়। সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত না হওয়ায় ওই সময় সরকারকে আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার দেয়া হয়নি।’ তবে অনুষ্ঠানে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবির বলেছিলেন, ‘ভুলভাল গার্ড অব অনার দিয়ে আমরা স্যালুট জানিয়েছিলাম।’

এদিকে দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ উন্মুক্ত মঞ্চটি জরাজীর্ণ থাকার পর সম্প্রতি তা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের মার্চে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য প্রবাসী সরকারের প্রথম জনসভাস্থল ‘উন্মুক্ত মঞ্চ’র শিলান্যাস করেছেন। সেখানে এখন কাজ চলছে।

সারাবাংলা/পিটিএম/এএসজি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন