বিজ্ঞাপন

পরিবহনে শিশুশ্রম: পেটে ভাতই পাই না… শিক্ষা পামু কই!

May 1, 2018 | 8:34 am

।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমার মাকে ছেড়ে বাবা চলে যান। আর ফেরেন নাই। শুনছি গাজীপুরে আরেটা বিয়ে করে সংসার করছেন। একবছর পর মা আবার বিয়ে করেন। সেখানে আমাকেও নিয়ে যান। কাজ না করলে আমাকে খাইতে দেবেন না, বলে দেন নতুন বাবা। তাই আট বছর বয়স থেকেই লেগুনায় কাজ শুরু করি।’ এভাবেই কর্মজীবনের শুরুর গল্পটি বলছিলো নাজমুল। এখন তার বয়স ১১ বছর। এই বয়সেই পরিবহন শ্রমিক হিসেবে তার তিন বছরের অভিজ্ঞতা।

তবে এই সময়ের মধ্যে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে শিশুটিকে।

বললো, ‘কাজের শুরুতে একটু ভুল হলেই মারধর করত। কান ধরে উঠ-বস করাত। কানতাম আবার কাজ করতাম।’

বিজ্ঞাপন

দুই দিকেই জ্বালা ছিলো, বললো নাজমুল।

‘এদিকে কাজ না পারলে মারধর, ওদিকে একদিন কাজে না গেলে মায়ে ভাত দিতো না।’

নাজমুল জানায় নতুন বিয়ের পর তার আরও দুই সৎ ভাইয়ের জন্ম হয়। ওরা এখন স্কুলে যায়। কিন্তু নাজমুলের ভাগ্যে জোটেনি স্কুল জীবন।

বিজ্ঞাপন

‘আমি শুধু তাদের স্কুলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখি। আমিও ৫ বছর বয়সে স্কুল গেছিলাম। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আর যেতে পারি নাই,’ বললো সে।

স্কুলে যেতে মন চায় না? শিক্ষা নিতে চাও না তুমি? জানতে চাইলে ১১ বছরের শিশুটি বলে উঠলো, ‘পেটের ভাতই পাই না, শিক্ষা পামু কই।’

শুনছি রাস্তায়-রাস্তায় অনেক আপা ও ভাইয়া নাকি লেখাপড়া শেখায়। কিন্তু যেতে পারি না লেগুনায় কাজ করার কারণে। মহাজন একটু আড়াল হইলেই ডাকাডাকি আর বকাঝকা শুরু করে দেন, বললো সে।

নাজমুল হাসান থাকে ওয়ারী থানাধীন নারিন্দা বস্তিতে তার মায়ের সাথে। প্রতিদিন রাইন থেকে গুলিস্তান রুটে যে শতশত লেগুনা চলাচল করে নাজমুল তারই একটি গাড়ির হেলপার।

বিজ্ঞাপন

এরই মধ্যে সে জানালো, মাঝেমধ্যে সে লেগুনা চালায়ও।

১১ বছরের এক শিশুর হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং! আঁতকে ওঠার মতো তথ্যই বটে।

সোমবার (৩০ এপ্রিল) সকালে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হচ্ছিলো নাজমুলের।

এই রুটে চলাচল করা অন্য আরও অনেক লেগুনাতে নাজমুলের মতো কম বয়সে অনেকে কাজ করছে। তাদের কারও বাবা নেই, কারওমা নেই আবার কারি বাবা-মা কেউই নেই। কেউ বা স্টেডিয়াম মার্কেটের বারান্দায় ঘুমায় আবার কেউবা লেগুনাতেই। চর থাপ্পড় আর কিল ঘুষি খেয়েই তাদের জীবন পার করতে হয়। এমনটাই জানা গেলো এই শিশু শ্রমিকদের সাথে কথা বলে।

রাজধানীর গুলিস্তান থেকে নীলক্ষেতগামী লেগুনাতেও দেখা গেলো এমন শিশুশ্রমের আধিক্য। সেখানেও বেশির ভাগ লেগুনার হেলপারের বয়স ১০ থেকে ১১ বছরের কিশোর। এমনকি আবার ৮ থেকে ৯ বছরের কিশোর রয়েছে।

এমন আরেক শিশুশ্রমিক জনি জানায়, বাবা-মা হারিয়ে এখন নানীর কাছে থাকে। লেগুনায় তার দিনে আয় ৫০ টাকা। তবে খাবার খরচ বাবদ আরও  ৫০ টাকা পায়। টাকা নানীর দিয়ে দেয়। স্কুলে যেতে মন চাইলেও যেতে পারে না সে। নানী বকা দেন। আর একদিন না গেলে লেগুনার মহাজন তার জায়গায় আরেকজনকে নেবে এই ভয়ে মিস করে না কাজ।

জনি চানখারপুল এলাকায় থাকে। নানী অন্যের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। জনি স্বপ্ন দেখে একদিন সে লেগুনা চালাবে। তারপর বাস চালাবে।

শিশু বয়সের এই শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেলো মারত্মক সব নেশায়ও আসক্ত তাদের অনেকে। সিগারেট, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল খাওয়ার কথা জানালো অনেকেই।

কোন নেশা করো কিনা জানতে চাইলে জনি বললো, এখনও নেশা করি নাই। আমার বয়সের যত আছে তারা সবাই খায়,  আমারেও দিতে চায়, আমি খাইনা।

‘শুনছি নেশা করে গাড়ি চালালে নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তাই নেশা করি না, মন্তব্য শিশুটির।

কি কি নেশা তারা করে জানতে চাইলে জনি জানালো, গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল ছাড়াও ওষুধের দোকান থেকে সিডাকসিন নামে ইনজেকশন দিয়েও নেশা করে কোনও কোনও শিশুশ্রমিক।

লেগুনায় শিশু শ্রমিকদের মূল আখরা রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোড এলাকা।

সেখান থেকে মিরপুর, গাবতলী, মহাখালী, মোহাম্মাদপুর, আজিমপুর ও জিগাতলা রুটে চলাচল করে লেগুনা।

লেগুনা স্ট্যান্ড কমিটির সভাপতি ইমতিয়াজ বাদশা জানালেন, প্রায় ১ হাজারের মতো লেগুনা চলাচল করে এসব রুটে।

এসব লেগুনায় দেড় শতাধিক শিশু কিশোর কাজ করে। যাদের বয়স ৮ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। কেউ পেটের দায়ে আবার কেউবা বাধ্য হয়েই এ কাজ করছে।

ফয়সাল (১২) জিগাতলা রুটে চলাচলকারী ইন্দিরা পরিবহনে হেলপারের কাজ করে। সে জানায়, বাবা মাছ ব্যবসায়ী আর মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। সংসারের অভাব মেটানোর জন্যই ফয়সালকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ানোর পর লেগুনার কাজে দিয়ে যান বাবা-মা। এখন সে প্রতিদিন ১৬০ টাকা মজুরি পায়।

ওই গাড়ির চালক মজিদ জানান,  ফয়সাল এরই মধ্যে গাড়ি চালানো শিখেছে কিন্তু বয়সে ছোট হওয়ায় তার হাতে গাড়ি দেওয়া হচ্ছে না।

মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী ইন্দিরা পরিবহনের আরেক লেগুনায় কাজ করে মিরাজ। সে জানায়, বাবা অসুস্থ বাসায় থাকেন আর মা একজনের বাসায় কাজ করেন। মা যে টাকা পান সেই টাকা দিয়ে বাবার ওষুধ  কেনা আর খাওয়া, বাসা ভাড়া চলে না। তাই ৭ বছর থেকেই লেগুনায় কাজ শুরু করে। তার মজুরি ১৮০ টাকা। স্বপ্ন গাড়ি চালানো শিখবে। এক সময় বড় গাড়িতে কাজ পাবে।

নেশার ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরাজ জানায়,  এখানে তার বয়সের যারা লেগুনায় কাজ করে, তাদের কেউই নেশা করে না।

নেশা করলে ওস্তাদরা মাইর দেয়, বললো মিরাজ।

লেগুনা স্ট্যান্ড কমিটির সভাপতি ইমতিয়াজ বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশুদের আমরা জোর করে নিয়ে আসি না। তাদের বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনেরা এসে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে যান। এরা তেমন কাজ করতে পারে না শেখাতেই দিন শেষ।’ একটু বড় ও চালাক হলে এক কাজ ফেলে অন্য জায়গায় চলে যায়। তবে আগের চেয়ে শিশুশ্রম কমেছে দাবি করে বাদশাহ বলেন, বেশির ভাগ লেগুনায় হেলপার নেই। যাত্রীরাই ভাড়া তুলে ড্রাইভারকে দেন।

আইন থাকার পরও শিশুশ্রম থামছে না কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক (বিএসএএফ) আব্দুস শরীফ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে যে পরিমাণ শিশু কাজ করে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ কাজ করে লেগুনাতে। চলন্ত লেগুনায় শিশুরা যেভাবে দাঁড়িয়ে হেলপারের কাজ করে, তাতে এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তাতে সন্দেহ নেই, বলেন তিনি।

‘যেভাবে এক হাত দিয়ে হাতল ধরে আরেক হাত দিয়ে ভাড়ার টাকা তোলে, একবার পড়ে গেলে বাঁচার উপায় থাকবে না। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার, বলেন এই মানবাধিকার নেতা।

সারাবাংলা/ইউজে/এমএম

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন