বিজ্ঞাপন

বিজয়ের দিনে দেশবিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করার শপথ

December 16, 2022 | 1:12 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত করে গঠন করা পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয়ের দিনটিতে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। ৯ মাসের যুদ্ধদিনে প্রাণ হারানো সব শহিদদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বন্দরনগরীর আপামর মানুষ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোকচিত্র প্রদর্শন, কুচকাওয়াজ, আলোচনা সভা, বিজয় শোভাযাত্রাসহ প্রতিবছরের মতো নানা আয়োজন চলছে।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (১৬ ডিসেম্বর) ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহিদ মিনারে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসা শুরু করে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সর্বস্তরের মানুষ বীর শহিদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

বিজয়ের ৫১ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির দোসরদের সব ষড়যন্ত্র পরাস্ত করে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন রাখার শপথ নিয়েছেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা বাংলা মায়ের সন্তানেরা।

১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমপর্ণের দিন অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয়ের বার্তা দিয়ে প্রথম সূর্যোদয়ের পর চট্টগ্রাম নগরীর কোর্ট হিলে ৩১ বার তোপধ্বনি দেওয়া হয়। সকাল ৮টায় নগর পুলিশের একটি চৌকস দলের ‘গার্ড অব অনারের’ মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজয় দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রামের সব সরকারি, বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া বর্ণিল আলোকসজ্জাও করা হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ভবনে।

পুলিশ র‍্যাবের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বেলা ১২টা পর্যন্ত শহিদ মিনারে চলে শ্রদ্ধা জানানো। সকালে শহিদ বেদিতে প্রথম শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন কাউন্সিলর ও চসিকের কর্মকর্তা-কমচারিরা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফুল দেন।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহসহ প্রশাসনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এরপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিজয় দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি সকালে নগরীর নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয় থেকে বিজয় শোভাযাত্রা নিয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর এই কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অশোক সাহার নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা লাল পতাকা মিছিল নিয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ, ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা শৃঙ্খলাভঙ্গ করে শহিদ মিনারে ঢুকে পড়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পৃথক মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা ঢোকার সময় নিয়ম অনুযায়ী সারিতে দাঁড়াননি তারা। এসময় শহিদ বেদিতে সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। তাদের স্লোগান-হট্টগোল, হুড়োহুড়িতে শহিদ বেদিতে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন দ্রুত সেখান থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন। ফুল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন খেলাঘরের শিশু-কিশোররা। কিন্তু তিন সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের একপাশে রেখে শহিদ বেদিতে উঠে পড়েন।

এদিকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উদীচী, বোধন, প্রমা, খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠনও শ্রদ্ধা জানায়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহণে বেলা গড়াতেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহিদ মিনার। শ্রদ্ধা জানানোর পুরো সময় মিছিল-স্লোগানে মুখর ছিল শহিদ মিনার এলাকা।

শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে। এতে তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ তৈরি হবে। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে। মুক্ত থাকবে সব সাম্প্রদায়িক অপশক্তি থেকে এবং মানবিক মানুষ হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিৎ জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের সন্তানদের নিয়ে শহিদ মিনারে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি সরওয়ার আলম মণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে এখনও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। তাদের পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশ বিরোধী আদর্শ ধারণ করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের অনেকে বেড়ে উঠেছে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলে ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছে। দেশবিরোধী সেই শক্তি আজ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সাজলেও এখন আবার স্বরূপে আর্বিভূত হচ্ছে কেউ কেউ। এই শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই এগিয়ে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়তে হবে।’

চসিকের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর নগরীর টাইগারপাসে অস্থায়ী কার্যালয় প্রাঙ্গনে স্থাপিত জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। এতে নগরীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। সিএমপি কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক এসময় সালাম গ্রহণ করেন। এসময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শারীরিক কসরত প্রদর্শন করেন।

উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের উদ্যোগে শুক্রবার সকাল থেকে নগরীর চেরাগি চত্বরে চলছে ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র’ প্রদর্শনী। বিকেলে সেখানে বিজয়মঞ্চে পরিবেশন করা হবে গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান। ছাত্র ইউনিয়নও চট্টগ্রামে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কলেজ, সিটি করপোরেশন পরিচালিত স্কুল-কলেজগুলোতেও বীর শহিদদের স্মরণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার হাসিনা জামাল ডিগ্রি কলেজে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরপর বিজয় দিবসের আলোচনায় অংশ নেন কলেজের অধ্যক্ষ আ জ ম শামসুদ্দিন ইলিয়াস, অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ূম, রেখা দাশ ও শীলা দাশগুপ্তা।

সারাবাংলা/আরডি/এমও

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন