বিজ্ঞাপন

হঠাৎ ছাঁটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা

May 1, 2018 | 3:45 pm

॥ এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট॥

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে মহা বিপদে পড়ি। দুই মাস চাকরি ছিল না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তখন রাস্তায় নেমে রিকশা চালাতে বাধ্য হই। খুব খারাপ লাগত। এতদিন গার্মেন্টসে কাজ করেছি, অথচ এখন রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছি। খুব নিচু মনে হতো। তখন বাসা ভাড়াও ঠিকমতো দিতে পারিনি। বাড়িওয়ালা ভালো হওয়ায় তিনি বাসায় রেখেছিলেন। তার কাছে এখনও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দেনা রয়েছে।’ এমনটাই বলছিলেন ওমর ফারুক (৩২)।

গত জানুয়ারিতে হঠাৎ নোটিশে বন্ধ হয়ে যায় তাদের তৈরি পোশাক কারখানা চুনজি নীট লিমিটেড। কোরীয় মালিকানাধীন ফ্যাক্টরিটি সেদিন শ্রম আইনের ধারা ২৬ অনুযায়ী এক নোটিশে বন্ধ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে সে একই আইন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতেই সমস্ত বকেয়া পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওমর ফারুকদের। অথচ রোববার (২৯ এপ্রিল) পর্যন্ত তা মেলেনি।

ফারুকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে এখনও তার ৬ মাসের বেতন পাওনা রয়েছে। শ্রমের ওই ন্যায্য পাওনা কবে পাবেন, তা জানেন না তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মী মিনা (২৮) বলছিলেন, ‘আমরা এখন এক বেলা খেতে পারলেও আরেক বেলা খেতে পারি না। বকেয়া আদায়ে বিভিন্ন স্থানে দৌঁড়াতে গিয়ে নতুন করে কোথাও চাকরিও নিতে পারছি না।’

বিজ্ঞাপন

কোরিয়ান অ্যাম্বাসি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ সব জায়গায় স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো আশ্বাস পাইনি। আমরা এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি।’

ফারুক ও মীনার মতো একই অবস্থা ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন এমন পাঁচ শতাধিক শ্রমিকের।

চুনজি নীট লিমিটেড কোরিয়া ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। উত্তর বাড্ডার সাতারকোলে এর কারখানা। বেতনভাতা পরিশোধসহ ফের কারখানাটি চালু করতে গত ২৭ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করেছে চুনজি নিট লিমিটেড’র শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স।

বকেয়া বেতন আদায়ে শ্রমিক সংগঠনটির পক্ষে এখনও বিভিন্ন স্থানে দেনদরবার চলছে। তবে সংগঠনটিও বকেয়া আদায়ে দিতে পারেনি কোন প্রতিশ্রুতি। খোদ পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এ বিষয়ে নির্বিকার।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা আমরা জেনেছি। আমরা এর মালিক সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি। জেনেছি প্রতিষ্ঠানটির মালিক কোরিয়া চলে গেছেন। মালিক দেশে থাকলে আমাদের পক্ষে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। এখন সরকার ও দূতাবাসকেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বন্ধ থাকায় সারাবাংলার পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের কারো বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

নানা সূচকে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক খাত, বায়ার অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স পোশাক খাত নিয়ে বেশকিছু ইতিবাচক বার্তাও দিচ্ছে তখনও শ্রমিকদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়শই। একই সঙ্গে নানা অজুহাতে চাকুরিচুত্যি, নিম্নতম মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশও তাদের অনুকূলে নয়।

এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে খারাপ পরিবেশের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন এ তথ্য উঠে আসে। আর প্রতিবেদনটির বড় অংশ জুড়েই ছিল বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের কর্মপরিবেশ।

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের সাড়ে চার হাজার গার্মেন্টসের মাত্র ১০ শতাংশে নিবন্ধিত কর্মী ইউনিয়ন রয়েছে। মাত্র ৩০ শতাংশ গার্মেন্টসে কর্মী অধিকার আইন মেনে চলা হয়। এছাড়াও মালিক ও প্রশাসন সবসময় ইউনিয়নের উপর আঘাত আনতে চায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে বলা হয়, কর্মীবান্ধব নয় এমন শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। ওই তালিকার শীর্ষে রয়েছে কাতার। এরপরই যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও ফিলিপাইন। শীর্ষ দশে বাংলাদেশের পরে রয়েছে গুয়েতেমালা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই কর্মীদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।

এদিকে বকেয়া বেতন ও ওভারটাইমের অর্থ আদায়ের জন্যই পোশাক খাত ৫৩ শতাংশ শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটি ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ত্রিপক্ষীয়তার অবস্থা এবং স্বয়ংসম্পুর্ণ শিল্প ও শ্রম সম্পর্কের সুযোগ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে গড়ে ২৫৯ টি শিল্প বিরোধ (শ্রমিক অসন্তোষ) সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে শ্রম অধিকার ও মান লঙ্ঘনের কারণে গড়ে ১৯৫ টি বিরোধ ঘটেছে। তবে ২০১৪ সালে পোশাক খাতেই ১৬৫ টি বিরোধের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে তা ছিল ১৯৯ টিতে। সে হিসেবে বছর ব্যবধানে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা কমেছে। ওই গবেষণায় বলা হয়, বকেয়া ও মজুরি ও ওভারটাইমের অর্থ প্রাপ্তির দাবির কারণেই পোশাক খাতের ৫৩ শতাংশ অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। তবে, শ্রম অসন্তোষের ৫৯ শতাংশই ঘটেছে কারখানার ভেতরে। ভেতর থেকে বাইরে ছড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ ও শুধুমাত্র বাইরে ছড়িয়েছিল ৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিলস।

তবে, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর দেশের পোশাক কারখানায় ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কারস সেফটি (অ্যালায়েন্স)’র দাবি, ২০১৩ সালের পর ৬০০ কারখানাকে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা প্রতিরোধের আওতায় এনেছেন তারা। প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিককে তারা অগ্নি নির্বাপক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তথ্যমতে, বিজিএমইএর আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের মত তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৬শ’ কারখানা আধুনীকিকরণ করতে না পারায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোতেও চলছে পর্যবেক্ষণ। তদারকি করছে সরকার, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’সহ অনেকে। ব্যপক হারে তদারকি বাড়িয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরও।

তথ্য উপাত্তের বাইরেও শ্রমিকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় শ্রমিক সংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে। ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্সের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এখনও গার্মেন্টসগুলোতে চাকুরিচ্যুতি একটি বড় সমস্যা। কোন কারণ ছাড়াই অনেক সময় শ্রমিকদের বাদ দেয়া হয়। আবার কোন কর্মচারীর অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের হলেও তাকে বাদ দেয়া হয়। কারণ নতুন শ্রমিকের চেয়ে অভিজ্ঞ শ্রমিককে বেশি মজুরি দিতে হয়। তিনি অভিযোগ করেন গার্মেন্টসগুলোতে শ্রমিকদের সহজে সংগঠিত হতে দেয়া হয়না।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সারাবাংলাকে বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে তার বিপরীতে সেভাবে তারা প্রাপ্যটা পাচ্ছে না। সেটা মজুরি হোক কিংবা কর্ম পরিবেশ, সব ক্ষেত্রেই। এটা না পাওয়ার জন্য বায়ার, মালিক ও সরকার; তিন পক্ষই দায়ী। তিনি বলেন, ৮ ঘন্টা কাজ করা ছিল মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য, সেখানে একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।

সরকার গঠিত নূন্যতম মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি বেগম শামসুন্নাহার ভূঁইয়া জানান, হঠাৎ ছাঁটাই একটি বড় সমস্যা। এছাড়া সব কারখানায় ইউনিয়ন নেই। বর্তমানে শ্রমিকেরা নূন্যতম মজুরির অপেক্ষায় রয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে তারা মতামত নিচ্ছেন। অধিকাংশ সংগঠনই বেতন ১৬ হাজার টাকা করে চাইছে।

বিলস’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মে দিবসের যে অঙ্গীকার ৮ ঘণ্টা  কাজ ও কাজের ন্যায্য মূল্য তার অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ। শ্রম আইনের বাস্তবায়ন নেই। যাদের জন্য মে দিবস সবার জন্যই সেই মানদণ্ডগুলো ঠিক করতে হবে। সাধারণ শ্রমিকদের জন্য কোন সামাজিক কর্মসূচি নেই। পেনশন ব্যবস্থা চালু নেই। সারাজীবন কাজ শেষে যখন বার্ধক্যে যাচ্ছে, তখন তারা বেকায়দায় পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে এখনও ১ লাখ টাকা দেয়া হয়, যা পর্যাপ্ত নয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে শ্রমিকেরা যে কোন শর্তে অধিক সময় কাজ করতে বাধ্য। মে দিবস মূলত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। শ্রমিক দিবসের কোন অর্থপূর্ণ তাৎপর্য নেই। অনেক শ্রমিক এই ছুটির দিনেই কাজ করছে, কাজ না পেলে না খেয়ে থাকছে।’

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রমিকদের কোন উন্নয়ন বা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান; কোন কিছুই তাদের নিশ্চিত হয়নি। বরং শ্রমিক নেতাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/জেএএম/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন