বিজ্ঞাপন

স্টিফেন হকিংয়ের জানা অজানা

January 8, 2023 | 2:51 pm

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

১৯৮৮ সালে টাইম পত্রিকায় স্টিফেন হকিং (১৯৪২-২০১৮) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যখন তার বয়স ১২ বছর তখন তার এক বন্ধু অন্য আরেক বন্ধুর সাথে তাকে নিয়ে এক প্যাকেট মিষ্টির একটা বাজি ধরেছিল। বাজিটা ছিল, তাকে (হকিং) দিয়ে ভবিষ্যতে আদৌ কিছু হবে কিনা। কিন্তু পরবর্তীতে তার আর জানা হয়নি সেই বাজিতে কে জিতেছিল!

বিজ্ঞাপন

সত্যি তাই। ৭৬ বছরের একটা মানুষ প্রায় অর্ধশত বছর ধরে যেখানে “Amyotrophic Lateral Sclerosis (ALS)” নামে ভয়ঙ্কর এক রোগে আক্রান্ত; তাকে দিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের দার্শনিক ব্যাখ্যা যে এতো অনন্য উচ্চতায় উঠবে সেটা কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল? পারেনি। আর পারেনি বলেই সম্ভবত সেই সাতসকালে তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে বাজি ধরেছিল। অবশ্য যখন বাজি ধরেছিল তখন সে ছিল সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে ঐ যে একটা কথা আছে, কোনো সকালই নিশ্চয়তা দিতে পারেনা দিনটা কেমন যাবে। সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যুগলবন্দীর মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটা দার্শনিক-পদার্থবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যিনি প্রথম দাঁড় করিয়েছিলেন তিনিই স্টিফেন হকিং।

১৯৪২ সালের ঠিক এই দিনে ৩০০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সর্বকালের সেরা জ্যোতির্বিদদের অন্যতম ইতালির গ্যালিলিও গ্যালিলি। দিনটি ছিল ৮ জানুয়ারি। এদিকে ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্মেছিলেন স্টিফেন হকিং। বেশ কাকতালীয় শোনালেও এটি সত্যি যে বিশ্বসৃষ্টি, এর পরিণতি এবং এর বিকাশের নানারকম বৈজ্ঞানিক বিধি নিয়ে উত্তর-আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে এই দুজনের অবদান সন্দেহাতীতভাবে আকাশছোঁয়া।

১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথমেটিক্স পদে ছিলেন তিনি, যে পদে একসময় ছিলেন স্যার আইজাক নিউটন। হেনরি লুকাসের নামে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬৪ সালের ১৮ জানুয়ারি অত্যন্ত সম্মানের এই পদটা সৃষ্টি করেন। বিশ্বের সবচেয়ে নামি পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই পদের গুরুত্ব এতটাই যে ১৬৬৩ সালে ক্ল্যাসিকাল গণিতবিদ আইজ্যাক বরো থেকে শুরু করে গত ৩৫৭ বছরে মাত্র ১৯জনকে এই সম্মানজনক পদে আনা হয়েছে। স্টিফেন হকিং এই পদে ছিলেন ৩০ বছর।

বিজ্ঞাপন

সেদ লয়েড ২০১৮ সালে ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড- এ লিখেছেন, ১৯৮৪ সালে ক্যামব্রিজের লেকচার হলে হকিং গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য মহাবিশ্বের কিনারা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। হুইল চেয়ারে স্থানু হয়ে বসে, বিড় বিড় করে কী যেন বলছেন। ভেসে উঠছে পর্দায়। বললেন, মহাবিশ্বের কিনারা খুব দূরে, তারপরেও আমরা সেখানকার একটা চিত্র আঁকতে পারি।… হকিং খুব উৎফুল্ল তবে উত্তেজিত। ট্রান্সলেশনের সময়টুকুর তর সইছে না। মটর-নিউরন ডিজিসে বিকলাঙ্গ শরীর নাড়াতে পারেন না তিনি। হুইল চেয়ারে একটু সরতে পারেন মাত্র। এভাবে সরতে সরতে হঠাৎ স্টেজের কিনারায় চলে যাওয়াতে চেয়ারটা প্রায় উল্টানোর মতো অবস্থা। প্রাণ যায় যায়! পা টা কোনোমতে ঝুলছে। ছাত্ররা লাফ দিয়ে চেয়ারের কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখে সে কোনোমতে ভাঁজ হয়ে বসে আছে। “মারা গেল নাকি?” সবাই আতঙ্কিত হয়ে ভাবছে। হঠাৎ বিড় বিড় শব্দ ভেসে আসলো। তিনি হাসছেন। বললেন, “মহাবিশ্বের কিনারায় আমি ভেঙে পড়েছি”। সত্যি এমন রসবোধ কয়জন মানুষের হয়?

মহাবিশ্ব নিয়ে দুর্নিবার আগ্রহ ছিল হকিংয়ের। তরুণ বয়স থেকে তিনি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের ওপর কাজ করতে শুরু করেন। ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তার চিন্তা সেই সময় থেকেই। একটা জ্যামিতিক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন কী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘূর্ণায়মান বস্তুগুলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অভিগমন প্রক্রিয়ায় সবকিছু ভেঙে পড়ে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় গ্রাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটি (gravitational singularities)।

১৯৭০ সালে রোজার পেনরোজের সাথে যৌথভাবে গ্রাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটি এবং মহাবিশ্বে তার প্রভাবের ওপর কাজ করেন তিনি। বলে রাখি গ্রাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটি বা স্পেস-টাইম সিঙ্গুলারিটি (Space-Time singularity) হল এমন একটা সময় বা পরিস্থিতি যেখানে গ্রাভিটেশনাল ফিল্ড পরিমাপ করতে গেলে এটা অসীমত্ত্বে পৌছায়। এটা এমন একটা মুহূর্ত যেখানে বিজ্ঞানের বিধিগুলো মারাত্মকভাবে একে অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে কিছুতেই ছাড়ানো যায় না; যেমন, নাইলনের সুতা এক জায়গায় জড়াজড়ি করে থাকলে তাকে ছাড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের ভেতরেই কৃষ্ণগহ্বরের একটা পূর্বাভাস ছিল, যেকোনো একটা নক্ষত্রের পেছন ফিরে তার শুরুর বিন্দুতে যদি আমরা পৌঁছাই তাহলে তার অসম্ভব গ্রাভিটেশনাল শক্তির কারণে সেটা ভেঙে পড়ে। মনে রাখতে হবে যে, এখান থেকে কোনো কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না এমনকি আলোকরশ্মিও না। এটার কারণ হচ্ছে, শুন্য মাধ্যমে গ্রাভিটেশনাল শক্তি আলোর গতিকেও পেছনে ফেলে। এর গতি তখন দাঁড়ায় ২৯৯, ৭৯২, ৪৫৮ মি/সে। এই পরিস্থিতিকে বলে চন্দ্রশেখর সীমা।

বিজ্ঞাপন

ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর ১৯৩০ সালে হিসেব করে বলেছিলেন সূর্যের থেকে ১.৪৪ গুন বেশি ভরের কোনো সাদা বামনের (নক্ষত্র) পক্ষে এভাবে ভেঙে পড়া সম্ভব না। চন্দ্রশেখর বলেন, কোনো নক্ষত্র যদি তার জ্বালানী শেষ করে এই সীমার ওপরে থাকে তাহলে সেটা হয় নিউট্রন স্টার কিম্বা কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে থেকে যাবে আজীবন। পেনরোজের সাথে আরেকটা বিষয় হকিং আবিষ্কার করেছিলেন, বিগব্যাং এর মুহূর্তে কীভাবে গ্র্যাভিটেশন সিঙ্গুলারিটির জন্ম দিয়েছিল। এটা পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি থিওরি নামে পরিচিত।

১৯৭৪ সালে হকিং ব্লাকহোল তাপমাত্রা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করেছিলেন চমৎকার গাণিতিক উপায়ে। কৃষ্ণগহ্বরের বঙ্কিম তলের ওপর কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি প্রয়োগ করে তিনি দেখিয়েছিলেন, কৃষ্ণগহ্বর কালোবস্তুর ন্যায় আচরণ করে, এবং এর থেকে তাপীয় বিকিরণ হয় যার মাত্রা “ħκ/2πkB” (প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক-কে 2π দিয়ে ভাগ, আর K হচ্ছে সার্ফেস গ্রাভিটি)। আমার মনে হয় কথাগুলো একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমি একটু অপেক্ষা করতে বলবো কিছু সময়ের জন্য। আশা করা যায়, পরে এর জট খুলে যাবে।

স্টিফেন হকিং এর উপর বরাবরই আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ থেকে সম্প্রতি ইউরোপ থেকে প্রকাশিত আমার বই “Understanding the Philosophy of Science (Scholar Press, EU)” এর সর্বশেষ অংশে হকিং এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুব সংক্ষেপে আমি তার একটা বায়োগ্রাফি দিয়েছিলাম। তখনই আমি উপলব্ধি করি মহাবিশ্ব নিয়ে তার গবেষণার কূলকিনারা পাওয়া যেসে কম্ম না। মহাবিশ্ব এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে যারা সাম্প্রতিক গবেষণা করছেন তারা হকিংকে অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। করতেই হবে, কারণ তিনি আইনস্টাইনের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে কাজ করছিলেন, এবং আশাবাদী ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান একটা ঐক্যবদ্ধ সূত্র আবিষ্কার করলে সেটা মানব ইতিহাসে হয়ে যাবে পয়লা নম্বর ঘটনা।

স্টিফেন হকিং ১৯৮২ সালে তার তাত্বিক গবেষণাগুলোকে একটা বই আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভাবেন, এ পর্যন্ত আমরা কীভাবে বিশ্বজগতের বর্তমান ধারণায় পৌঁছালাম এবং মানুষ কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানে একটা সর্ববিধ ঐক্য সূত্রের (Grand Unification Theory) কাছাকাছি পৌঁছানোর পথে, সেটা নিয়ে সাধারণ পাঠকের জন্য একটা বই লিখবেন। তবে প্রকাশক মনে করিয়ে দেন বইটাতে যেন কোনো গাণিতিক ইকুয়েশন না থাকে, প্রতিটা ইকুয়েশনের জন্য পাঠক অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়া হয় তাকে। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৮৮ সালে। লিখলেন “A Brief History of Time”। প্রকাশক প্রথমে ভেবেছিলেন এটা কোনো বিমানবন্দরের হকার্স বুকশপে কিংবা রেলস্টেশনে পড়ে থাকবে। ২০১৩ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাথে এক কথোপকথনে হকিং বলেছিলেন তিনিও খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। তবে প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল একটানা ১৪৭ সপ্তাহ নিউইয়র্কে এবং টাইমস অব লন্ডনের তালিকায় ২৩৭ সপ্তাহ একটানা বেস্ট সেলার লিস্টে নাম ছিল। এ পর্যন্ত ২৫ মিলিয়নের ওপর এই বই মানুষ কিনেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, কতো মানুষ বইটা আদতে বুঝতে পেরেছে তা নিয়ে নিদারুণ এক সংশয় স্বয়ং হকিংয়েরই ছিল।

বিজ্ঞাপন

চার্লস ক্রাথুমার হার্বাড-ট্রেন্ড-ফিজিশিয়ান ওয়াশিংটন পোষ্টে লিখেছিলেন তিনি দুবার বইটা আগামাথা পড়েছিলেন, কিন্তু বোঝেননি কিছুই। খুব সঙ্গত কারণেই আমি আজকের লেখার শিরোনামটা ঠিক করে যে খানিকটা বিপদের ভেতর তা নিশ্চয় পাঠক বুঝতে পারছেন।

“A Brief History of Time” আকারের দিক থেকে খুব বেশি বড় না। ভাগ্যিস এটার কলেবর বাড়েনি, কারণ বাড়লে পাঠকের যে ভোগান্তি বাড়বে তা বোধকরি বলার অবকাশ রাখে না। বইটিতে দশটি অধ্যায়; এগুলো হলো যথাক্রমে মহাবিশ্ব সংক্রান্ত আমাদের চিত্র, স্থান ও কাল, প্রসারমান মহাবিশ্ব, অনিশ্চয়তাবাদ, আদিকণা ও প্রকৃতির বল, কৃষ্ণগহ্বর, হকিং বিকিরণ, মহাবিশ্বের শুরু এবং ভবিষ্যৎ, সময়ের তীর, পদার্থবিজ্ঞানে সমন্বয় এবং পরিশেষ।

মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে চিত্র আমরা পেয়েছি তার প্রাথমিক ধারণা নিয়ে বইটা শুরু হয়েছে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান মহাবিশ্বের যে ধারণায় আজ পৌঁছেছে তার গোড়াপত্তন করেন এরিস্টটল আর টলেমী। এরিস্টটল “On the Heavens” নামে একটা বইয়ে পৃথিবীটা যে একটা থালার মতো চাকতি নয় বরং গোলকের মতো সেটা জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি একটা কসমোলিজিক্যাল মডেল দিয়েছেন যার কেন্দ্রে ছিল পৃথিবী। এই চিত্রকে একটু বিস্তৃত করে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমী নামে একজন ধর্মযাজকও একটা চিত্র উপস্থাপন করেন যা দিয়ে মহাকাশের বস্তুগুলোর একটা ভবিষ্যৎবাণী করা কিছুটা হলেও সম্ভব ছিল। টলেমীর এই বিশ্বচিত্রে স্থির তারকারাজীর বাইরে যে বিরাট শূন্যতা ছিল সেখানে ছিল স্বর্গ আর নরকের জন্য নির্ধারিত স্থান। সোজা কথায় এরিস্টটল আর টলেমীর সেই যৌথ প্রজেক্টের নাম ছিল জিও-সেন্ট্রিক থিওরি। ১৫১৪ সালে কোপার্নিকাস নামে এক পোলিশ পুরহিত এর বিকল্প এক চিত্র উপস্থাপন করেন।

কোপার্নিকাস বললেন তার এই চিত্রের মাঝে আছে সূর্য। আর অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্ররাজি এর বাইরে নিজ নিজ পথে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটাই হেলিও-সেন্ট্রিক মতবাদ। তবে তার এই নতুন মডেলটা ছিল তখনকার ধর্মাশ্রিত বিশ্বাসের উল্টো। তিনি ভীষণ প্রাণভয়ে বিষয়টা প্রচার করেন। তবে তার এই মডেলের আরও বেশি সূক্ষ্মতা পায় ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও এর কাছে। তিনি একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে এর পরীক্ষামূলক খুঁটিনাটি প্রচার করলেন। কিন্তু গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে চলে নাকি উপবৃত্তাকার পথে চলে সে সমস্যার সমাধান করেন কেপলার। কেপলার কয়েকটা সূত্র দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করেন। আর এসবের ভিত পরিশেষে মজবুত হয় যখন নিউটন তার “Principia” বই প্রকাশ করেন ১৬৮৭ সালে। নিউটন বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্বটা অগণিত সংখ্যক নক্ষত্র দিয়ে তৈরি, আর এগুলো মোটামুটিভাবে স্থিতিশীল। তবে নিউটনের সমসাময়িক অনেকেই তার এই বিশ্বাসকে মানতে পারেনি যার মধ্যে ছিলেন জার্মান দার্শনিক হেনরিখ আলবার্স।

একটা সমস্যা দেখা দিলো, মহাবিশ্বের কোনো শুরু ছিল কিনা, নাকি এটা সবসময়ই এমনই ছিল। মহাবিশ্ব সবসময় এমন ছিল নাকি এর শুরু ছিল তা নিয়ে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট “Critique of Pure Reason” গ্রন্থে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করেন। অত্যন্ত দুর্বোধ্য এসব যুক্তিতর্ক অবশ্য ছিল শুধু অনুমান। তবে এসব বিতর্কের একটা অবসান প্রায় হয়ে যায় ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী এডুয়িন হাবল যখন বিশেষ ধরণের শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখলেন নীহারিকাগুলো ধীরে ধীরে কীভাবে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবলের এই পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করা গেল এগুলো নিশ্চয় একসময় একই জায়গায় ছিল অসীম তাপ আর চাপের ভেতর, যেখানে বিজ্ঞানের বিধিগুলো সব ভেঙে পড়ে। হকিং বলেন, ২০ বিলিয়ন বছর আগে সম্ভবত এই মহাবিশ্বের সূত্রপাত এবং বিরাট এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা।

জ্ঞানীয় পরিমণ্ডলে মানুষের চিন্তার কয়েকটা মৌলিক বিষয়বস্তুর ভেতর স্থান ও কালের ধারণা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এরিস্টটল ভাবতেন স্থান পরম। নিউটনও তাই। কোনো একটা বস্তু স্থির নাকি চলমান সেটা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের ইনারশিয়াল ফ্রেম অব রেফারেন্স এর ওপর। যেমন, যখন আমরা বাসের ভেতর বসে থাকি পাশাপাশি যদি আরেকটা বাস ঠিক একই বেগে চলে তাহলে মনে হবে চলমান বাসটা স্থির, অন্যদিকে সামনের দিক থেকে ধেয়ে আসা বাসটাকে মনে হবে গতিশীল।

এরিস্টটল প্রমাণ করেছেন ভারি বস্তু সবসময় হালকা বস্তু থেকে আগে মাটিতে পড়ে। গ্যালিলিও বললেন কথাটা ঠিক কিন্তু যদি এর মাঝে বাধা না পায় তাহলে সব বস্তু একই সাথে পড়ে। তিনি একটা বাতাস শুন্য স্থানে এক টুকরা লোহা আর পাখির পালক দিয়ে এই পরীক্ষা করলেন এবং দেখালেন, যে জায়গায় বাতাস নেই সেখানে ভারী কিংবা হালকা বস্তুর পতনের হার একই। নিউটন আরও বিশ্বাস করতেন যদি কোনো একটা ঘটনা দুজন দুটো আলাদা গতির ফ্রেমে বসে ঘড়িতে রেকর্ড করেন তাহলে তাদের কাছে এর পরিমাণ হবে একই। বর্তমানে এটা অবশ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ড্যানিস বিজ্ঞানী রোমার বৃহস্পতি গ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন আলো একই বেগে ভ্রমণ করে। তবে জেমস ম্যক্সওয়েল আলোর একটা বিশেষ ধর্মের কথা জানতে পারেন; সেটা হলো, আলো তরঙ্গ আকারে চলতে থাকে।

তবে ম্যাক্সওয়েল বিশ্বাস করতেন আলো ইথারের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে, আর ইথার হচ্ছে বাতাসে কাল্পনিক ঢেউ; পুকুরে যেমন ঢিল ছুঁড়লে তরঙ্গগুলো ক্রমান্বয়ে চারিদিকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে। মাইকেলসন-মার্লির পরীক্ষায় অবশ্য ইথারের কোন অস্তিত্ব মেলেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনস্টাইন এবং হেনরি পয়েনকেয়ার পরীক্ষা করে বলেন, আলোর গতি ব্যাখ্যা করতে ইথারের অস্তিত্বের কোন প্রয়োজন হবে না। আর সাথে সাথে স্থানের পরমত্ব খসে পড়ে। ইতোমধ্যে আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিকতত্ত্বের মাধ্যমে জানান, পর্যবেক্ষকের গতি যাইহোক না কেন আলোর গতি সবক্ষেত্রে ধ্রুবক। যেমন, আমরা যখন গাড়িতে যাই, তখন সামনের দিক থেকে কোন কিছু ধেয়ে এলে আমাদের কাছে সবসময় মনে হয় আমার গাড়ি ও ধেয়ে আসা গাড়ির গতিবেগের যোগফলের গতিতে গাড়িটা ধেয়ে আসছে। আমার গাড়ি যদি ১০০ কিমি বেগে চলে আর অন্য গাড়িটা যদি ২০০ কি মি বেগে ধেয়ে আসে তাহলে আমার মনে হবে গাড়িটা ৩০০ কি মি বেগে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আইনস্টাইন বলেন, আলো সবসময় একই বেগে আসবে। অর্থাৎ এর গতি সবসময় একই এবং সেটা ২৯৯, ৭৯২, ৪৫৮ মি/সে।

এছাড়া আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের মাধ্যমে দেখালেন স্থান এবং কালকে আলাদা করে চিন্তা করার কোনো উপায় নেই। (আমার পূর্ববর্তী একটা লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি)। আপেক্ষিকতত্ত্ব অনুসারে তাই দাঁড়ালো স্থান-কাল। রোজার পেনরোজ সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব ব্যবহার করে দেখালেন, এই মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল, এবং মন খারাপ হলেও সত্যি যে একদিন তা শেষ হবে।

তৃতীয় অধ্যায়ে হকিং বর্ণনা দিয়েছেন, কীভাবে মহাবিশ্বটা প্রসারিত হচ্ছে। অষ্টাদশ শতকে স্যার উইলিয়াম হার্সেল রাতের আকাশে অনেক নক্ষত্রের অবস্থান আর পরিচয় নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি তারাগুলোর দূরে সরে যাওয়ার পরিমাপের একটা পদ্ধতি পেয়েছিলেন। তিনি ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার করে এই হিসেবটা করেছিলেন। খুব সহজ এই হিসেবটা আমরাও করতে পারি। তারকাগুলোর উজ্জ্বলতা কীভাবে একে অন্যের থেকে ফিকে হয়ে যায় সেটা পরিমাপ করেন হাবল। ডপলার নামে এক বিজ্ঞানী অবশ্য শব্দের পরিমাপ করতে গিয়ে এই সূত্র ব্যবহার করেন। গ্যালাক্সিগুলোর এই দূরে যাওয়া থেকে সহজেই বোঝা যায়, এরা নিশ্চয় একসময়ে এক জায়গায় ছিল।

একটা বেলুনের ওপর দুটো কলমের ফোঁটা দিয়ে রেখে ফুঁ দিলে যেমন ফোঁটা দুটো ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। রোজার পেনরোজ আলোর কনিস্কতা (Light cone) ও সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব ব্যবহার করে দেখিয়েছিলেন একটা নক্ষত্র যখন ভেঙে পড়ে তখন অসীম ঘনত্বে পৌঁছায় এবং তা একটা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। হকিং এবং পেনরোজ দেখালেন মহাবিশ্বটা এই এক অনন্যতায় সৃষ্টি হয়েছে যেটাকে সিংগুলারিটি বলে। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে বিগব্যাং থিওরির বিপরীতে স্টিডি স্টেট থিওরি নামে আরেকটা থিওরি আছে। এই তত্ত্বে মনে করে, মহাবিশ্বটা সবসময় যেমন আছে তেমনই থাকবে, কোনো পরিবর্তন হবে না। হারমেন বডি, টমাস গোল্ড, ফ্রেড হোয়েল ছিলেন এই স্টিডি স্টেট থিওরির সমর্থক। আমি কয়েক বছর আগে বাংলাবাজার পুরনো বইয়ের দোকানে অনাদরে পড়ে থাকা ফ্রেড হোয়েলের একটা বই কিনেছিলাম জলের দামে।

অনিশ্চয়তাবাদ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে নির্ধারণবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এবং প্রকারন্তরে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানকে এক গৌরবদায়ক কলঙ্কের মাঝে ছুঁড়ে ফেলছে। এই তত্ত্বের ভেতর এটাই প্রকাশিত হয়েছে কোনো কণিকার গতি (speed) আর অবস্থান (position) ঠিকঠাক নির্ণয় করা অসম্ভব। আমরা এটা মাপতে গিয়ে যখন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (high frequency) আলোকরশ্মি ব্যবহার করি তখন এর অবস্থান ঠিকঠাক পেলেও গতি পাইনা; আবার নিম্ন শক্তির আলোক রশ্মি (low frequency) ব্যবহার করলে অতি সূক্ষ্ম গতি পাওয়া যায়, পাওয়া যায় না অবস্থান। এ এক আজব গোলক ধাঁধা। আলোক তরঙ্গের থাকে চূড়া (crests) আর খাঁদ (troughs); একটা চূড়া থেকে অন্য চুড়ার দূরত্বকে বলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। অনেক সময় একাধিক আলোক তরঙ্গ একে অন্যের ওপর হস্তক্ষেপ করে। যখন একাধিক আলোক তরঙ্গ একে অন্যের সাথে মিশে যায় তখন সেটা আবার একটা আলোক তরঙ্গের মতো আচরণ করে তবে সে তরঙ্গ অবশ্যই পূর্বের থেকে আলাদা।

কোয়ার্ক হলো পদার্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণিকা যা বিশ্বের ক্ষুদ্রতম বস্তু দিয়ে তৈরি। পদার্থবিজ্ঞানী মারে গেলম্যান এর নাম দেন কোয়ার্ক। ১৯৬৯ সালে গেলম্যান এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। এর ছয়টা সুগন্ধ (বৈশিষ্ট) আছে: উপরে (আপ), ডাউন (নিচু), স্ট্রেঞ্জ (অজানা), চার্ম (মোহিত), বটম (নীচ) এবং টপ (সবার উপরে)। আশ্চর্যের ব্যাপার কোয়ার্কের আকার ভীষণ ছোট এবং সম্ভবত দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়েও ছোট। প্রতিটা প্রোটন বা নিউট্রন কণিকা তিনটা কোয়ার্ক কণিকা দ্বারা গঠিত। কোয়ার্ক সাধারণত তিন রঙের হয়, লাল, সবুজ এবং নীল। তবে এন্টি-কোয়ার্কও আছে। প্রকৃতিতে চারটি বল আছে। এগুলো হলো, গ্রাভিটি, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স, স্ট্রং ফোর্স, উইক ফোর্স। আসলে এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন বল বিজ্ঞানীরা চেয়েছেন একত্রিত করে একটি মাত্র সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে। (এ বিষয়ে আগের একটা লেখায় বিস্তারিত জানিয়েছি)। এটাই মহান ঐক্যবদ্ধ সূত্র নামে পরিচিত।

ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আমাদের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। আসলে ব্লাকহোল কী?

১৯৬৯ সালে জন হুইলার নামে একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী এই শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন। আলোর দুটো বৈশিষ্ট্য, একটা কণা ধর্ম, অন্যটা তরঙ্গ। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এ দুটো বৈশিষ্টকেই স্বীকার করে নিয়েছে।

১৮৮৩ সালে জন মিচেল নামে একজন বিজ্ঞানী বলেন, যদি কোনো তারকার খুব বেশি ভর আর ঘনত্ব থাকে তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতো শক্তিশালী হয় যে সেখান থেকে আলো আর নির্গত হতে পারে না। ওখান থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই তারকার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ দারুণভাবে পেছনে টেনে ধরে।

আমরা জানি, যখন বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন বা বায়ু নিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে চুপসে যায় তখন সৃষ্টি হয় তারকা। এবং তারকাটা সংকুচিত হওয়ার ফলে বায়ু ক্রমশ ঘন হয় এবং নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর ফলে হাইড্রোজেন গ্যাস হিলিয়ামে পরিণত হয়। এটা অনেকটা হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মতো। আর এর ফলে যে তাপ বিকিরিত হয় সেজন্য তারকাগুলো চকচক করে। তারকাগুলোর যখন ভেতরের ও বাইরের চাপের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয় তখন এর মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়। তবে একসময় হাইড্রোজেন গ্যাস ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যেতে থাকে। জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

আগেই বলেছি কোনো এক তারকার ভর যদি চন্দ্রশেখর সীমার নিচে থাকে তাহলে শেষমেশ তা সাদা বামনে (white dwarf) পরিণত হয়। কোনো একটা তারকার ভর যদি আমাদের সূর্যের ভরের চেয়ে ২৫গুন বেশি হয় তাহলে সেটা একসময় ভেঙে পড়ে ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়।

হকিং শেষমেশ কী বলতে চেয়েছেন তার ব্রিফ হিষ্ট্রি’তে? এককথায় পদার্থবিজ্ঞানে একটা ঐক্যবদ্ধ সূত্রের অনুসন্ধান করা। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকত্ত্ব অন্যদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে রয়ে গেছে দারুণ দ্বন্দ্ব। আসলে এ দুটোই দৃশ্যমান জগতকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। তাই পদার্থবিজ্ঞানীদের দরকার পড়েছে কোয়ান্টাম গ্রাভিটি সংক্রান্ত একটা ব্যাপক তত্ত্বের যার মাধ্যমে এই দৃশ্যমান জগতকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়।

আমাদের এই মহাবিশ্বটা এক অপার বিস্ময়ের জায়গা। এর উপর আমাদের কতো আগ্রহ, কতো কৌতূহল, কতো গল্প। স্টিফেন হকিংয়ের ব্রিফ হিষ্ট্রি অব টাইম সম্ভবত এমন এক বৈজ্ঞানিক মডেল আমাদের কাছে হাজির করেছে যার কূলকিনারা আমরা হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারবো এক জ্ঞানতাত্বিক পরিসীমার মধ্যে। যেমন করে কবির চিন্তায় এই বিস্ময় উঠে এসেছিল, “আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান”।

(কৈফিয়ত: এই লেখাটা স্টিফেন হকিং এর বায়গ্রাফি আকারে লেখা হয়নি, শুধু তার একটা বইয়ের উপর অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আর সেজন্য তার জীবনের অনেক সংগ্রামী অধ্যায় এর ভেতর নেই। সামনের কোন এক সময় হয়তো তার জীবনী এবং অন্য কোন বই নিয়ে আলোচনা করা যাবে)।

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন