বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে প্রকল্প: চীন সরে গেলেও হাত বাড়িয়েছে ভারত-জাপান

January 7, 2023 | 10:56 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী এবং আখাউড়া-সিলেট রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী চীন। চীন সরে যাওয়ার পর এই দুই প্রকল্পসহ তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এক বছরেরও বেশি সময় বিকল্প অর্থদাতা খোঁজার পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে জাপান ও ভারত।

বিজ্ঞাপন

গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত মিশ্রগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দেবে জাপান। এরই মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো- অপারেশন এজেন্সি- জাইকা এই প্রকল্পে সমীক্ষা হালনাগাদ করছে। প্রকল্পটি দুই ধাপে বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে জাপানের অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। তবে বাস্তবায়নে বিলম্বের পাশাপাশি বাড়তে পারে ব্যয় অন্যদিকে আখাউড়া- সিলেট রেললাইন মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তর করার প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে মোট ২৭ টি প্রকল্প বাস্তবায়নে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে দুই দেশ। জি টু জি ভিত্তিতে ২২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সায় দিয়েছিল চীন। ওই ২৭ প্রকল্পের একটি জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। ১৫ হাজার ২৩২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৮ সালে অনুমোদন দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) বৈঠক।

বিজ্ঞাপন

ওই প্রকল্পে চীনের ঋণ দেওয়ার কথা ছিল ৮ হাজার ৭৫৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। জানা যায়, ২০১৯ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি- সিসিজিপি ঠিকাদারের সঙ্গে ১১ হাজার ৫৮৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার চুক্তি অনুমোদন করে। এই ব্যয়ের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৬২ কিলোমিটার মূল লাইনসহ ১৯৮ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন নির্মাণ কাজ। যেখানে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ দাঁড়ায় ৫৯ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু এই দূরত্বে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ খরচ মাত্র ১৯ কোটি টাকা।

ওই প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়ের বিষয় সামনে এলে এই প্রকল্প থেকে ব্যয় কমানোর সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি সুপারিশ করা হয় একই সঙ্গে অনুমোদন পাওয়া আখাউড়া- সিলেট প্রকল্পও। সে সুপারিশ আমলে নিয়ে দুই প্রকল্পের একটি থেকে ৪০ শতাংশ আরেকটি থেকে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২০ শতাংশ ব্যয় কমানোর অনুশাসন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী রেলপথ প্রকল্প থেকে এই পরিমাণ নির্মাণ খরচ কমানোয় কম টাকায় কাজ করতে রাজি হয়নি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপ- সিআরবিজি। ওই ঘটনায় জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী, আখাউড়া- সিলেট এই দুই প্রকল্প থেকেই হাত গুটিয়ে নেয় চীন। এরপর থেকে বিকল্প অর্থায়ন খুঁজতে শুরু করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একবছর পর প্রকল্পে অর্থায়ন করার আগ্রহ নিয়ে সামনে আসে জাইকা। সংস্থাটি গত জুন থেকে সমীক্ষার কাজ শুরু করেছে।

রেলওয়ে সূত্রমতে, জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ৮৫ দশমিক ৫২ কিলোমিটার এবং এদিকে ঈশ্বরদী থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত ৭৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার এই দুইভাগে ভাগ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় জাইকা। এই লাইনের জন্য দুই অংশে সাতটি স্টেশন পুনঃনির্মাণ এবং ১৪ টি স্টেশন সংস্কার করা হবে। আরও নির্মাণ করতে হবে ৬৬ টি বড় এবং ১৩৮টি ছোট সেতু। আর পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার ১০৬ একর জমি অধিগ্রহনের প্রয়োজন হবে।

বিজ্ঞাপন

রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে জানান, চীন অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এখন জাইকা বাস্তবায়ন করবে। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হলেও তা শুরু করতে ২০২৫ সাল লেগে যাবে। তিনি আরও বলেন, ‘নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে ব্যয়ও বাড়াটাও স্বাভাবিক।’

এদিকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এরই মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করে ফেলছে সরকার। এ প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগোয় তার সমীক্ষা দেখে। সরকারের অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যথাযথ সমীক্ষা না করার কারণে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পায়ে পায়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পটি ছিল জি টু জি পদ্ধতি। একনেক অনুমোদনের পর প্রকল্প বাস্তবায়নে আর বাধা থাকে না। সেজন্য একনেকে প্রস্তাব করার আগেই যাচাইবাছাই করা উচিত ছিল। যেহেতু বিদেশি অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে সেহেতু মার্জিতভাবে ব্যয় কমানো যেত। কারণ ব্যয় যদি বাড়িয়ে ধরা হয়ে থাকে। তাহলে সে নেগোশিয়েশনে সরকারের কর্মকর্তারাও ছিলেন। যে পদ্ধতিতে প্রকল্পের ব্যয় কমানো হয়েছিল এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে সংকট তৈরি হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক কারণেও স্থান কাল ভেদে প্রকল্প ব্যয় বাড়ে।’

অন্যদিকে আখাউড়া- সিলেট রেলপথকে মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তর করার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০১৮ সালে। ওই প্রস্তাবে ২৩৯ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগ্রেজে রূপান্তর করার জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। কিন্তু এমন সমজাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে ব্যয় পর্যালোচনায় এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয় সামনে আসে। ফলে এই পরিমান টাকা খরচ করে আখাউড়া- সিলেট প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন।

বিজ্ঞাপন

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল ওই প্রকল্পে পাথর, স্লিপার, রেলসহ অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ ও ব্যয় চলমান সমজাতীয় অন্য প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় আখাউড়া- সিলেট প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা সমজাতীয় চারটি প্রকল্পের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। এতো ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে না বলে মত দেয় পরিকল্পনা কমিশন।

একই সঙ্গে প্রকল্পের ভৌত কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ছাড়া একক ঠিকাদারের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতেও আপত্তি জানিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের মতে, চীনের অন্যান্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্যও দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। কমিশন তার প্রতিবেদনে আরও বলেছিলো, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন হলে ট্রেন চলাচলের ফ্রিকোয়েন্সি বা হার বাড়বে না। এ রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হলে প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও। তিনি এ রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করার সুপারিশ করে চিঠিও লিখেছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিতে ওই সময় একনেক বৈঠকে প্রস্তাব করা না হলেও ২০১৯ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকল্পটি একনেকে তোলেন। প্রাথমিক ব্যয় ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একনেক অনুমোদন পায় আখাউড়া- সিলেট মিশ্র গেজ রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। এরমধ্যে মূল নির্মাণকাজের জন্য ১২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। একনেক অনুমোদনের পর প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয় আবারও আলোচনায় আসে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনে যৌক্তিকীকরণ কমিটি ঠিকাদারের অংশ থেকে ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করে। ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয় রেললাইন নির্মাণের ক্ষেত্রেও। ব্যয় কমানোয় কম খরচে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় চীন। এরপর জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী প্রকল্পের মতো আখাউড়া- সিলেট প্রকল্পের জন্য বিকল্প অর্থদাতা খুঁজতে শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরপর এই প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায় ভারত। শোনা যাচ্ছে আখাউড়া- সিলেট প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।

এদিকে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নেও চীনা ঠিকাদারের সঙ্গে ব্যয় নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী, আখাউড়া- সিলেট প্রকল্পের সঙ্গে জয়দেবপুর- ময়মনসিংহ প্রকল্পেরও অর্থায়ন থেকে সরে যায় চীন। এখন জয়দেবপুর- ঈশ্বরদী, আখাউড়া- সিলেট প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে আশার আলো দেখা গেলেও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে জয়দেবপুর- ময়মনসিংহ প্রকল্প। রেলওয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থায়ন না পাওয়া গেলে প্রকল্পটি বাদ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।

সারাবাংলা/জেআর/একে

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন