বিজ্ঞাপন

কম্পিউটার গেম থেকে ইউরোপের সর্বকনিষ্ঠ কোচ উইল স্টিল

February 1, 2023 | 5:05 pm

সাহাবার সাগর, নিউজরুম এডিটর

ফ্রান্স লিগ ওয়ানের ক্লাব রেইমস এফসি। প্রতি ম্যাচে ডাগ আউটে থাকা কোচের জন্য গুনতে হচ্ছে ২৫ হাজার ইউরোর জরিমানা। তবুও কোচ হিসেবে তাকেই ধরে রেখেছে রেইমস। ব্রিটিশ দম্পতির সন্তান উইল স্টিলের উত্থান পুরোটাই গল্পের মতো। ৩০ বছর বয়সে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের সর্বোকনিষ্ঠ কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর যার শুরুটা কম্পিউটারে খেলা গেম থেকে।

বিজ্ঞাপন

ইউরোপিয়ান জায়ান্ট পিএসজির ঘরের মাঠে ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটে পিছিয়ে থাকার পর ৯৬তম মিনিটে এসে গোল করে সমতায় ফেরে রেইমস। এরপর বুনো উল্লাসে তরুণ এক লোককে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। প্রথম দেখায় রেইমসের খেলোয়াড় বলেই মনে হতে পারে তাকে। কিন্তু পরক্ষণে দেখা মিলবে কোনো খেলোয়াড়ি পোশাক পরিহত নন তিনি আবার বসছেনও না খেলোয়াড়দের বেঞ্চে। দেখা গেল তিনি বসছেন রেইমসের কোচের জন্য রাখা নির্ধারিত স্থানে। হ্যাঁ! ৩০ বছর বয়সী উইল স্টিল যার নেই উয়েফার প্রো লাইসেন্স। তবুও তিনি দায়িত্বে আছেন রেইমসের।

২০২২ সালের ১১ অক্টোবর রেইমসের সহকরি কোচের পদ থেকে প্রধান কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়ে ৩০ বছর বয়সী উইল স্টিলের কাঁধে। তখনও উইলের ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কোচিং করানোর জন্য লাইসেন্স যোগাড় করতে পারেননি তিনি। আর লাইসেন্স না থাকা কোনো ব্যক্তিকে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হলে ওই ক্লাবকে প্রতি ম্যাচের জন্য ২৫ হাজার ইউরো করে জরিমানা গুনতে হয়। তবে এতেও পিছ পা হয়নি রেইমস।

বিজ্ঞাপন

প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে রেইমসের ডাগ আউটে উইল। এই সময়ে তার অধীনে রেইমস ১২টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছে। আর এতেই ৩ লাখ ইউরো জরিমানা গুনেছে রেইমস। উইলের অধীনে খেলা প্রতিযোগিতামূলক সবকটি ম্যাচেই এখন পর্যন্ত অপরাজিত। যার মধ্যে ৬টি ম্যাচে জয় পেয়েছে রেইমস।

যার মধ্যে শেষ ড্র’টি এলো লিওনেল মেসি, নেইমার জুনিয়র আর কিলিয়ান এমবাপেদের বিরুদ্ধে। উইলের নিজেরও যা বিশ্বাস হচ্ছিল না। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, ‘আমি কেন এটা করছি? আমি কিভাবে এটা করছি? আমি তাদের মতো খেলোয়াড়দের বিপক্ষে কোচিং করাচ্ছি? এটা কিভাবে সম্ভব হলো!’

ফেরা যাক তাহলে উইল স্টিলের শুরুর দিনগুলোতে। শুরুটা নিজের ঘরের কম্পিউটারের টেবিলে বসে। আর আট-দশটা ১৪ বছর বয়সী ছেলেদের মতো করেই। কম্পিউটারের টেবিলে বসে নানান গেম খেলা দিয়ে। তবে সেসব গেমের ভেতর উইলের নজর কাড়ে ফুটবল ম্যানেজার নামক ফুটবলভিত্তিক গেমটি। শুরুটা সেখান থেকে।

বিজ্ঞাপন

উইলের কণ্ঠে, ‘সাধারণ ১৪ বছর বয়সী একটি বাচ্চার মতো আমিও রাত ১০টার দিকে ফুটবল ম্যানেজার গেম খেলার সময় মনে মনে বলতাম আর একটা ম্যাচ খেলেই আজকের মতো শেষ। তবে সেই একটি ম্যাচ করতে করতে কখন যে ভোর ৪টা বেজে যেত তা আমার খেয়ালই থাকতো না। সেখান থেকেই ফুটবলের প্রতি আর ফুটবলের কোচিং প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মে। আর এরপর ধাপে ধাপে আজ আমি এখানে।’

আর ঠিক ওই সময়টাতেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন থেকে ফুটবল কোচ হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু উইলের। এরপর প্রিস্টনের মায়েরস্কফ কলেজ যোগ দেন উইল। প্রিস্টন নর্থ এন্ডে ২০ বছর বয়সে ক্লাবের একাডেমির খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন ধরে কোচিং স্টাফের নানান পদে কাজ করেছেন। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে বেলজিয়াম শীর্ষ লিগের নানান ক্লাবের সহকরি কোচ। আর সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে ২০২১ সালে এসে রেইমসের প্রধান কোচ অস্কার গার্সিয়ার সহকরি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অস্কার গার্সিয়ার সহকরি হিসেবে প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালের অক্টোবরে এসে তার স্থলাভিষিক্ত হন উইল। সে সময় স্প্যানিশ কোচ অস্কারকে অব্যাহতি দেওয়াটা কিছুটা অমানবিক মনে হচ্ছিল সকলের কারণ ওই সময় দারুণ খেলছিল রেইমস। তবে পরবর্তীতে জানা যায় অস্কারের মেয়ে দীর্ঘদিন দিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিল আর চাকরি ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ পরে তার মেয়ে মারা যায়।

বিজ্ঞাপন

৩০ বছর বয়সী উইল স্টিল যার পেশাদার ফুটবল কোচিং করানোর লাইসেন্স নেই তাকেই দেওয়া হলো রেইমসের দায়িত্ব। তবে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না উইলের। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি আমাকে বলতো যে ৩০ বছর বয়সে আমি লিগ ওয়ানের কোনো দলের কোচ হবো তখন আমি তাকে ঘুষি মারতাম।’

‘৩০ বছর বয়সে আমি নেইমার, এমবাপে, সার্জিও রামোস, মার্কো ভেরাত্তি এবং লিওনেল মেসিদের বিপক্ষে কোচিং করাবো। আর প্রতিপক্ষের ডাগ আউটে ক্রিস্তফ গ্যালতিয়ের থাকবে, এটা ভাবতে গেলে নিজেকে পাগল মনে হয়।’—যোগ করেন উইল।

তবে একটি ভিডিও গেমই যে তার জীবনটা বদলে দিয়েছে তা আবারও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। উইল বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি ফুটবল ম্যানেজার গেমটা আমার জীবনে এত বড় প্রভাব ফেলবে। আর এই গেম খেলে অনুপ্রাণিত হয়েই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করি। আর বাস্তব জীবনে আমি শেষ পর্যন্ত এখানে পৌঁছাতে পেরেছি। গেমটা সত্যিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’

‘আমি ছোট থেকেই গেম খেলার সময় এটা নিজের ভেতর ঠিক করে রেখেছিলাম। ছোট বেলায় গেম খেলতে গিয়ে নিজেকে যেমন মনে হতো এখন ডাগ আউটে বসে ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে আমার।’—আরও যোগ করেন উইল।

তবে প্রতি ম্যাচে রেইমসের ডাগ আউটে থাকার কারণে ক্লাবটিকে ২৫ হাজার ইউরো জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এর ব্যাপারে উইল বলেন, ‘ক্লাবের সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে। তারা বলেছে তারা আমার ক্যারিয়ারে বিনিয়োগ করবে ততদিন যতদিন আমি তাদের জয় এনে দিতে থাকবো।’

২০২১/২২ মৌসুমে লিগ ওয়ানে ১২ নম্বরে থেকে শেষ করেছিল রেইমস। ৩৮ ম্যাচে ১১ জয়, ১৩ ড্র আর ১৪ ম্যাচে হেরেছিল তারা। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২০ ম্যাচে ৫ জয়, ১১ ড্র আর মাত্র ৪ ম্যাচে হেরেছে রেইমস। লিগে অবস্থান করছে ১১ নম্বরে। যদিও উইলের অধীনে এখনো লিগ ওয়ানে একটি ম্যাচেও হারের মুখ দেখেনি রেইমস।

তবে মৌসুমের এখনও বাকি অনেকটা পথ। তবে কোপা দে ফ্রান্সের শেষ ষোলতেও পৌঁছে গেছে রেইমস উইলের হাত ধরে। আর মৌসুম শেষে ঠিক কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে রেইমস তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস। কিন্তু উইল স্টিল আর রেইমস এই কাহিনী সিনেমা কিংবা কোনো রোমাঞ্চকর কাব্যের চেয়ে কম নয়। ভিডিও গেম থেকে শুরু করে এখন ইউরোপের সর্বোকনিষ্ঠ ফুটবল কোচ উইল স্টিলের এ কাহিনী!

সারাবাংলা/এসএস

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন