বিজ্ঞাপন

নিরিবিলি বইমেলায় পাঠকের ভিড়

February 15, 2023 | 11:05 pm

আসাদ জামান

অমর একুশে বইমেলার ১৫তম দিন বুধবার। টিএসসির রাজু ভাস্কর্য অতিক্রম করার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল পেরেকবিদ্ধ গীতাঞ্জলি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মুখে তাঁর কচটেপ আঁটা। এক তরুণ নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছেন।

বিজ্ঞাপন

বাঁশের কাঠামোর ওপর বইয়ের ছেড়া পৃষ্ঠা দিয়ে এই ভাষ্কর্য কারা বানিয়েছে, কেন বানিয়েছে, কী থিম এ ভাস্কর্যে প্রোথিত হয়েছে, সে সম্পর্কে বিন্দু-বিস্বর্গ জানেন না ওই তরুণটি। বইমেলা থেকে বই কিনে বাসায় ফেরার সময় ভাস্কর্যে চোখ আটকে যায় তার। এর পর রাজু ভাস্কর্যের বেদিতে বইগুলো রেখে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

আপনি কি ক্যাম্পাসের? সোজা উত্তর ‘না’। আমি আউট সাইডার। এসেছি খিলগাঁও থেকে। লেখাপড়া করি সিটি কলেজে। কী নাম আপনার? মঈনুল হক রাজ। এই ভাস্কর্যের দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? আমি তো ঠিক বলতে পারব না। সম্ভাবত Freedom of speech- এর বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন এর ক্রিয়েটররা।

মঈনুল হক রাজ কিছু না বুঝেও যেটুকু বুঝেছেন, বয়সের তুলনায় সেটা কম কিছু না। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া একজন ছাত্রের এই ‘বুঝ টুকুর’ পেছনে কারণও আছে। ছুটির দিনে নয়, পহেলা ফাল্গুনেও নয়, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেও নয়, বন্ধুকে নিয়ে সে মেলায় এসেছে নিরিবিলি একটা দিনে। যে দিনটায় মূলত পাঠকেরা বইমেলায় আসেন, উদ্দেশ্য থাকে বই কেনা, বই পড়া।

বিজ্ঞাপন

টিএসসি মোড় থেকে মেট্টোরেল স্টেশনের নিচ দিয়ে বিরিক্তকর পথ পেরিয়ে ফাল্গুনের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় সোজা গিয়ে হাজির হলাম মেলার মূলমঞ্চে। সেখানে স্বরচিত কবিতা পাঠ চলছিল। কবি মোহাম্মদ সাদিক ও কামরুল হাসানের তিনটি কবিতা ধৈর্যের সঙ্গে শ্রবণ শেষে কবি টিমুনী খান রীনোর স্বরচিত কবিতা পাঠ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে উঠতে হলো। আরেকটু ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারলে নজরুল সংগীতের দুই প্রখ্যাত শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা ও খায়রুল আনাম শাকিলের গান শুনে আসা যেত। কিন্তু সেটা আর হলো না!

বইমেলার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সময় যে ক’জন মানুষ চোখে পড়ল, তার অধিকাংশের হাতেই বই। নিরিবিলি পরিবেশে যারা মেলায় এসেছেন, তাদের মধ্যে ‘বই পোকার’ সংখ্যাই বেশি। ঘুরে-ফিরে পছন্দের বই কেনার সুযোগ নিতে এমন নিবিরিলি দিন বেছে নিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

মেলার কালী মন্দির গেটে কথা হয় মহাখালী থেকে মেলায় আসা কারুল ইসলামের সঙ্গে। দুই হাত ভরা বই নিয়ে মেলা থেকে বের হচ্ছিলেন তিনি। ইউপিএল, ঐতিহ্য, প্রথমা, অন্যপ্রকাশ ও পাঠক সমাবেশ থেকে প্রচুর বই কিনেছেন বিদেশি এক এনজিওতে কর্মরত কামরুল ইসলাম।

এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বইমেলা থেকে নিরিবিলি পরিবেশে পছন্দের বই কেনার জন্য ছুটির দিন এবং বিশেষ দিবস এড়িয়ে চলাই ভালো— সেদিকটা মাথায় রেখেই পরিবার নিয়ে আজ মেলায় এসেছি। মেলার পরিবেশ এবং লেআউট চমৎকার। আজ ধুলাবালিও কম।’

কালী মন্দির গেট দিয়ে মেলায় প্রবেশের পর বাম দিকে মোড় নিলেই ‘অস্তিত্ব’ প্রকাশনীর স্টল। এক ইউনিটের এই স্টলটি সাজাতে যে রুচি এবং নান্দনিকতার পরিচয় দিয়েছেন প্রকাশক, তাতে বলতেই হয়- ‘ছোট’ জায়গার মধ্যেও বড়’ করে ফেলা সম্ভব।

কথা হয় ‘অস্তিত্ব’ স্টলের বিক্রকর্মী রমা বর্মণের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, আজ বইমেলায় লোক কম হলেও বিক্রি মোটামুটি ভালো। যারাই স্টলে আসছেন, পছন্দের বই পেলে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অস্তিত্ব থেকে প্রকাশিত ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটির ছয় কপি বিক্রি হয়েছে, যা বইমেলার ১৫ দিনের মধ্যে রেকর্ড। অন্যান্য বইও ভালোই বিক্রি হয়েছে আজ।

বিজ্ঞাপন

বইমেলার এম্ফি থিয়েটারের পূর্ব পাশে ‘সুলেখা প্রাকশনীর’ স্টল। তিন পাশ খোলা এ স্টলেও প্রচুর বইয়ের সমাহার। বড় বড় প্রকাশনীর নান্দনিক প্যাভিলিয়নের মতো সুলেখা প্রকাশনীর দুই ইউনিট বিশিষ্ট স্টলে তেমন ভিড় নেই। তবে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো— এমনটিই জানালেন সুলেখার ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ ফাহাদ।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওভার অল বিক্রি ভালো। অন্তত গত তিন/চার বছরের মধ্যে এবার বইবিক্রি ভালো হচ্ছে। আজ বইমেলায় ভিড় কম। সেই তুলনায় বিক্রি বেশি। আমাদের এখানে সৃজনশীল এবং ধর্মীয় বই বেশি। বিক্রির দিক থেকেও এই বইগুলো এগিয়ে।’

‘আজকে আমাদের নতুন একটা বই এসেছে— ইসলাম ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন। যদি সুযোগ থাকে এই বইটা নিয়ে একটু লিখেন’— অনুরোধ শাহ নেওয়াজ ফাহাদের।

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শহীদ ইকবাল। আলোচনায় অংশ নেন হাফিজ রশিদ খান, অনিকেত শামীম এবং সরকার আশরাফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাজ্জাদ আরেফিন।

প্রাবন্ধিক বলেন, ‘লিটল ম্যাগাজিন একটা চিরনতুন প্লাটফর্ম। সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা— এ সবই লিটল ম্যাগাজিনের মূল বৈশিষ্ট্য। লিটল ম্যাগাজিনের দিগ্বলয় চলিষ্ণু ও ক্রমবর্ধমান। এর ধারণা-বৈশিষ্ট্য কিংবা পন্থা ও পরিণাম অনতিক্রান্ত নয়, ক্রমবিকশিত ও পরিবর্তিত। আর তা নিশ্চয়ই এদেশের মৃত্তিকা ও সংস্কৃতিকে অনুরুদ্ধ করেই পরিচালিত ও বিকিশিত। পরিচর্যায় পথটিও সে লক্ষ্যেই নির্ধারিত।’

আলোচকরা বলেন, প্রচলিত ও গতানুগতিক সাহিত্যচর্চার বাইরে নতুন চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে যে পত্রিকা, সেটাই লিটল ম্যাগাজিন। নতুন ও তরুণ লেখকরাই লিটল ম্যাগাজিনের ধারক। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার একটি মাধ্যম লিটল ম্যাগাজিন। আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার স্ফুরণ ঘটে এই পত্রিকায়। প্রচলিত ধারণাকে অস্বীকার করে নতুন কিছু বিনির্মাণ করতে চায় বলে লিটল ম্যাগাজিন সবসময়ই স্পর্ধিত এক চর্চার নাম।

সভাপতির বক্তব্যে সাজ্জাদ আরেফিন বলেন, ‘সাহিত্য আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রথাবিরোধী তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনের গৌরবকে সমুজ্জ্বল রাখতে হবে। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিময়তা ফিরিয়ে আনার জন্য তরুণদের উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন দিলারা হাফিজ, হাকিম আরিফ, আঁখি সিদ্দিকা এবং জয় শাহরিয়ার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন মোহাম্মদ সাদিক, কামরুল হাসান, সাজ্জাদ আরেফিন, টিমুনী খান রীনো, কৌমুদী নার্গিস। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আফতাব আহমেদ মাহাবুব, পলি পারভীন, কাজী মদীনা। এছাড়া ছিল সুলতানা আক্তার’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্কেচ একাডেমি অব ফাইন আর্টস’ এবং দীপ্তি রাজবংশীর পরিচালনায় ‘বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদ’র পরিবেশনা।

সংগীত পরিবেশন করেন লীনা তাপসী খান, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, খায়রুল আনাম শাকিল, সুমন মজুমদার, মাহবুবা রহমান, সম্পা দাস, ডা. তাপস বোস, শহীদ কবীর পলাশ, আফরিদা জাহিন জয়ীতা। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), সুমন রেজা খান (কি-বোর্ড), মো. মনিরুজ্জামান (বাঁশি), ফিরোজ খান (সেতার)।

আগামীকাল ৩ ফাল্গুন, ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ফরিদ আহমেদ দুলাল। আলোচনায় অংশ নেবেন মাহমুদ কামাল, হেনরী স্বপন, নজিবুল ইসলাম ও সাজ্জাদ আহসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অনীক মাহমুদ।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন