বিজ্ঞাপন

বইমেলায় প্রচণ্ড ভিড়, প্রচুর বিক্রি

February 17, 2023 | 10:55 pm

আসাদ জামান

অমর একুশে বইমেলার ১৭তম দিন শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনসংলগ্ন বইমেলার প্রবেশ পথের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি। এবারের বইমেলায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনসংলগ্ন প্রবেশ পথে এ ধরনের দীর্ঘ মানববসারি আজই প্রথম।

বিজ্ঞাপন

অর্থাৎ মেলায় ঢোকার আগেই টের পাওয়া গেল, মেলায় আজ ভীষণ ভিড়। বাকি রইল শুধু বই বিক্রির খবরটা। কয়েকটা স্টল-প্যাভিলিয়নে ঢুঁ মারলে এবং মানুষের হাতের দিকে চোখ বুলালেই, সেটিও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপাতত মেলায় প্রবেশ করা যাক।

সারিবদ্ধ মানুষগুলোকে টপকিয়ে বিশেষ কোটায় সিরিয়াল ছাড়া বইমেলায় প্রবেশ করে দারুণ একটা ধাক্কা খতে হলো। আরে! লেখক বলছি মঞ্চ গেল কই? এক রাতের ব্যবধানে পুরো মঞ্চটা উধাও হয়ে গেল!

যেখানে মঞ্চ ছিল, সেখানে তিন পুলিশ সদস্য চেয়ার পেতে বসে আছেন। মঞ্চের চিহ্নটুকুও নেই। জানতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য বললেন, ‘রাতে ডিউটি শেষ করে যখন বাসায় যাই, তখনও এখানে মঞ্চ ছিল। আজ এসে দেখি নেই। কোথায় গেছে মঞ্চ, আমরা তার কিছুই জানি না।’

বিজ্ঞাপন

সব ছেড়ে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ খুঁজতে বেরিয়ে পড়তে হলো। অবশেষ টিএসএস সংলগ্ন প্রবেশ ও বের হওয়ার পথের কাছে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের সন্ধান মিলল। সেখানে ম্যারিনা নাসরিন কথা বলছিলেন তার নতুন বই নিয়ে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন কথা সাহিত্যিক মনি হায়দার। তাদের এই কথাপোকথন শুনছিলেন বেশ কিছু কৌতূহলী দর্শক।

গত ১৬ দিন ধরে বইমেলার এক অবহেলিত কোণে পড়েছিল ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ। খাবারের বিশাল দুই প্যান্ডেলের মাঝখানে ছোট্ট একটা মঞ্চ তৈরি করে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ। সপ্তাহের পাঁচদিন এ পাশের গেট বন্ধ থাকায় এদিকে কেউ আসে না। কেবল মাত্র ভোজন রসিকরা এদিকটায় আসে। তাদেরকে ডেকে জোর করে তো আর ‘লেখক হওয়ার গল্প’ শোনানো যায় না। অতঃপর মেলার ১৭তম দিনে এসে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ বেশি লোকের আনাগোনা যেখানে, সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

‘লেখক বলছি’ মঞ্চ খুঁজতে খুঁজতে মোটামুটি পুরো বইমেলা চক্কর দেওয়া হয়ে গেল। আলাদা করে আর ঘোরাঘুরির প্রয়োজন পড়ল না। মেলা জুড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ। মানুষের ভিড়ে কোথাও কারও সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ মেলা দায়। বইমেলায় ভিড় বাড়লে পাঠক, লেখক, দর্শনার্থী এমনকি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলা কঠিন হয়ে যায়। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।

প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও ‘পুথি নিলয়’ প্রকশনীর জেনারেল ম্যানেজার বিলু কবীর আন্তরিকতা নিয়েই কথা বললেন সারাবাংলার সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আজকের বিক্রি খুবই ভালো। প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। এ দিনটার জন্যই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। বলতে পারেন, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।’

কোন বইটি বেশি বিক্রি হচ্ছে?— আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সমগ্রের পকেট সংস্করণ বের করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজস্র লেখা এবং এই লেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরকালীন। কিন্তু বড় মাপের বই বহন করা এবং পড়া অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। সেদিকটা বিবেচনায় রেখে রবীন্দ্রনাথের কাব্য, উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্রসহ সব ধরনের লেখা আমরা পকেট সংস্করণে বের করেছি। এগুলো প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বইও আজ ভালো বিক্রি হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

চারুলিপি প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়নেও প্রচণ্ড ভিড়। প্রায় ২০ জন বিক্রয় কর্মীর বিক্রি করা বইয়ের পেমেন্ট গ্রহণ এবং ক্যাশ স্লিপ কাটার কাজে ব্যস্ত ছিলেন ম্যানেজার মাসুদ পারভেজ। তারপরও কথা বলতে চাইলে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘এবারের বইমেলায় আজকের দিনটা সবচেয়ে ভালো যাচ্ছে। আজকের বই বিক্রি আশানুরূপ। আমাদের এখানে কিশোর সমগ্র এবং থ্রিলার টাইপের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সুশীল টাইপের পাঠকেরা সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. আনিসুজ্জামান, জাহানারা ইমামের বই কিনছেন।’

‘আলোঘর’-এর স্টলে কথা হয় প্রকাশনী সংস্থার মার্কেটিং ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে মেলা খুব একটা ভালো যায়নি। আজকে বই বিক্রি ভালো হয়েছে। আমরা এদিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সামনে এ রকম দুয়েকটা দিন পেলে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে।’

বইমেলা থেকে দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে মালিবাগের বাসায় ফিরছিলেন মো. আমিনুল ইসলাম। দুই রাজকন্যা— আসফিয়া (৭) এবং আসিয়া (৫)-এর জন্য বই কিনেছেন বেশ কয়েকটি। বয়সের সঙ্গে যায়, এমন বইগুলোই কিনেছেন তিনি। তবে নিজের জন্য কোনো বই কেনেন নি।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নিজের জন্য বই কিনতে হলো অনেক স্টল ও প্যাভিলিয়নে ঢুঁ মারতে হবে। কিন্তু এই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে সেটা সম্ভব না। সে কারণে শুধু ওদের জন্য কিনেছি।’

দুই হাতভর্তি বই কিনেছেন ধানমন্ডি থেকে মেলায় আসা নীলোফার ইয়াসমিন। পেশায় এনজিও কর্মকর্তা নীলোফার ইয়াসমিনের বেশিরভাগ বই ক্যারিয়ার এবং উন্নয়ন ভাবনা বিষয়ক। এছাড়া কয়েস সামীর সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ এবং লেজলি হেইজেলটনের ‘দ্য প্রফেট’ বইটিও কিনেছেন তিনি।’

নীলোফার ইয়াসমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইমেলায় না এসেও বই কেনা যায়। কিন্তু বইমেলা তো শুধু বই কেনা-বেচার জায়গা না। এটা আমাদের একটা জাতীয় উৎসব। এই যেমন ধরুন, প্রায় দশ বছর পর ভার্সিটি লাইফের এক বন্ধুর সঙ্গে আজ দেখা হল। বইমেলা আমাদেরকে এক জায়গায় করতে পেরেছে।’

বইমেলার পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভেতরটা সুন্দর। কিন্তু মেলার প্রবেশ পথ, বিশেষ করে টিএসসিসংলগ্ন গেট একেবারেই যা তা। এখানে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি।’

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ক-শাখায় ১ম হয়েছেন আরোহী বর্ণমালা, ২য় হয়েছেন অংকিতা সাহা রুদ্র এবং ৩য় হয়েছেন জুমানা হোসেন। খ-শাখায় ১ম হয়েছেন সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ, ২য় হয়েছেন আনিশা আমিন এবং ৩য় হয়েছেন অদ্রিতা ভদ্র এবং গ-শাখায় ১ম হয়েছেন আদিবা সুলতানা, ২য় হয়েছেন তাজকিয়া তাহরীম শাশা এবং ৩য় হয়েছেন সিমরিন শাহিন রূপকথা। বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার, দেওয়ান সাঈদুল হাসান এবং ড. শাহদাৎ হোসেন নিপু। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবার্ষিক ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মহীবুল আজিজ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অনিরুদ্ধ কাহালি ও মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ আকরম হোসেন।

প্রাবন্ধিক বলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সমকালীন জাতীয়তাবাদী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। যে তিনটি প্রধান উপন্যাস তিনি রেখে গেছেন সেগুলোর মুখ্য অন্বেষা দেশ, দেশের সামগ্রিক চিত্র এবং পারিবারিক-সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণ। শুধু তাই নয়, এমন উপন্যাসও তাঁর রয়েছে যেখানে পাওয়া যায় দৈশিক বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিশদ চিত্র। ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসের চরিত্র, সংলাপ, কাহিনি এবং বর্ণনার অন্তরালে নিহিত থাকে অন্তর্বাস্তবের এমন ইঙ্গিত, যা কখনও প্রত্যক্ষ এবং কখনও প্রতীকী।

আলোচকবৃন্দ বলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সমকালীন সমাজচিত্র ও মানবচরিত্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই মানবজীবনের অনিশ্চয়তা, ভয়, অস্তিত্বের সংকট- সবকিছুই তাঁর রচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র বর্ণনাশৈলী ও ভাষা উপস্থাপন বিশেষভাবেই স্বতন্ত্র। বাংলা সাহিত্যের গল্প, উপন্যাস ও নাটক প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সৃষ্টিকর্ম যেমন ক্রমান্বয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তেমনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ হয়ে উঠছেন আরও বেশি সমসাময়িক।

সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সাহিত্যকে বিচার করা এখন সময়ের দাবি। তাঁর সাহিত্য-বিশ্লেষণে তত্ত্বের শৈল্পিক ও নান্দনিক ব্যবহারের দিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মাসুদুজ্জামান, ভাগ্যধন বড়–য়া, ম্যারিনা নাসরিন এবং ইউসুফ মুহম্মদ।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন ফরিদ আহমদ দুলাল, ফেরদৌস নাহার, তপন বাগচী, জাহিদ মুস্তাফা, আফরোজা সোমা এবং আশরাফ জুয়েল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সুকান্ত গুপ্ত, রুবিনা আজাদ এবং মো. শওকত আলী।

আগামীকাল ৫ই ফাল্গুন, ১৮ই ফেব্রুয়ারি শনিবার। অমর একুশে বইমেলার ১৮তম দিন। মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়, চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে। এছাড়া সকাল ১০:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গোলাম মুস্তাফা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মোহিত কামাল ও রাজীব কুমার সরকার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সুব্রত বড়ুয়া।

সারাবাংলা/এজেড/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন