বিজ্ঞাপন

যে ৪ সূত্রে দিয়াজের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের দাবি সিআইডি’র

February 26, 2023 | 10:08 am

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে ৪টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এগুলো হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর টিপুর সঙ্গে বিরোধ, নিজের গ্রুপের কয়েকজন নেতাকর্মীর ‘বেঈমানি’, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পরিবারের চাপ এবং বান্ধবীদের সঙ্গে টানাপোড়েন।

বিজ্ঞাপন

চারটি বিষয় যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের দাবি করে সিআইডি বলছে, হতাশা থেকে দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইন থেকে দেয়াও কয়েকটি পোস্টকেও এক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সিআইডি মামলার এজাহারে আনা খুনের অভিযোগকে ‘তথ্যগত ভুল’ হিসেবে উল্লেখ করে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী দিয়াজ ইরফান চৌধুরী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলার মুখ’ নামে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন দিয়াজ।

২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে নিজ বাসা থেকে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় তার মা জাহেদা আমিন চৌধুরীর দায়ের করা হত্যা মামলা ৬ বছর ধরে তদন্ত শেষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (মেট্রো ও জেলা) আব্দুস সালাম মিয়া।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, চট্টগ্রামে বদলিজনিত শেষ কর্মদিবসে তিনি বহুল আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্রটি জমা দিয়েছেন। এরপর ওইদিনই তিনি বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগ দিতে চট্টগ্রাম থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকায় চলে যান।

সূত্রমতে, ৪৭ পাতার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৩৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন সাক্ষী হলেন- দিয়াজের বান্ধবী ছাত্রলীগের এক নেত্রী। ২০২১ সালের ১ মার্চ চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল উদ্দীনের আদালতে তিনি জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দিতেই মূলত মামলার মোড় ঘুরে যায়। জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যকে ভিত্তি ধরেই এগিয়ে যায় মামলার তদন্ত।

তবে সিআইডি যেসব বিষয়কে আত্মহত্যার সপক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করছে, দিয়াজের পরিবার এর সবগুলোই প্রত্যাখ্যান করে সারাবাংলার কাছে খণ্ডন করেছে। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা ‘আদিষ্ট ও প্রভাবিত’ হয়ে আসামিদের পক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

বিজ্ঞাপন

মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই জবানবন্দি
জবানবন্দি দেয়া দিয়াজের ওই বান্ধবী ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। প্রথমে চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর গ্রুপে থাকলেও পরবর্তীতে দিয়াজ ইরফানের গ্রুপে যোগ দেন। দিয়াজের সুপারিশে তিনি চবি ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পান। এরপর দিয়াজের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে জবানবন্দিতে ওই নেত্রী দাবি করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, দিয়াজের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তার খালাতো বোন (চবি’র সাবেক ছাত্রী) ও একই বিভাগের এক সহপাঠী ছিলেন।

জবানবন্দিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে তাকে জানায়, দিয়াজের সঙ্গে ১০ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কের পর তারা বিয়ে করেছেন। দিয়াজের বাসায় দুই ছাত্রীর উপস্থিতিতেও এ বিষয়ে কথাবার্তা হয়। তখন দিয়াজ বিষয়টি অস্বীকার করেন। এরপর জবানবন্দি দেওয়া ছাত্রীর সঙ্গে দিয়াজের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রামের এএসপি আব্দুস সালাম মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই ছাত্রীর সঙ্গে দিয়াজের প্রেমের সম্পর্ক হলে সাবেক প্রেমিকা বাদ সাধেন। এ নিয়ে টানাপোড়েন ছিল। জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আবার দিয়াজের আরও কয়েকজন বান্ধবী ছিল। তাদের কাউকে কাউকে দিয়াজ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। এ নিয়েও তার মধ্যে হতাশা ছিল বলে আমরা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি। এসব টানাপোড়েন নিয়ে দিয়াজের মধ্যে হতাশা ছিল।’

জানতে চাইলে দিয়াজের বড় বোন অ্যাডভোকেট জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিয়াজের সঙ্গে শুধু একজনেরই সম্পর্ক ছিল। যার সঙ্গে ১০ বছর ধরে সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে শুধু সেই। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমরা ৫০ কেজি মিষ্টি নিয়ে মেয়েটার নানার বাড়ি গিয়ে আংটি পরিয়ে এসেছিলাম। দিয়াজের মৃত্যুর পর মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়। এর বাইরে দিয়াজের আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। যে মেয়েটি জবানবন্দি দিয়ে সম্পর্কের দাবি করেছে, সেটা পুরোপুরি মিথ্যা। সে আলমগীর টিপুর গ্রুপের মেয়ে। টিপুই তাকে চক্রান্ত করে দিয়াজের গ্রুপে পাঠিয়ে বিভিন্ন গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে।’

বিজ্ঞাপন

নীপার দাবি, টিপুর লিখে দেওয়া জবানবন্দি ওই ছাত্রী আদালতে গিয়ে পাঠ করেছেন।

আলমগীর টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটি সে অর্থে আমার গ্রুপের কর্মী বা আমার ফলোয়ার সেরকম নই। সে ছাত্রলীগ করতো। বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাদের সাথে থাকতো। পরে সে দিয়াজের সাথে বাংলার মুখ গ্রুপে যুক্ত হয়।’

জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের অক্টোবরের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ কোটি টাকার একটি টেন্ডার নিয়ে দিয়াজসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে আলমগীর টিপুর দ্বন্দ্ব হয়। এ নিয়ে উভয়গ্রুপে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। টিপু গ্রুপের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দিয়াজকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর টিপু গ্রুপের নেতাকর্মীরা দিয়াজের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে ভাঙচুর করে। এই ঘটনায় দিয়াজ খুবই মর্মাহত হন। তিনি ফোনে কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে এ ঘটনার বিচার দেন। কিছুদিন পরে জানায়, আ জ ম নাছির উদ্দীন এ ঘটনার বিচার করে দেবেন বলে দিয়াজকে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা। তবে বিষয়টি দিয়াজের পরিবারের পক্ষ থেকেও এর আগে কয়েকবার বলা হয়েছিল।

দিয়াজের বোন জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘টেন্ডার নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। টিপু-জামশেদরা ছিল টেন্ডারের পক্ষে। আর সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা ছিলেন টেন্ডারের বিপক্ষে। দিয়াজ সাবেক ছাত্রনেতাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এটা নিয়ে আমাদের বাসায় টিপুর ছেলেরা হামলা করে ভাঙচুর করে। আমরা সেটার বিচার নাছির (আ জ ম নাছির উদ্দীন) সাহেবকে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বিচার করেননি।’

আলমগীর টিপু টেন্ডার নিয়ে দিয়াজের সঙ্গে বিরোধের বিষয় অস্বীকার করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি টেন্ডারে অংশ নিইনি। দিয়াজও টেন্ডারে অংশ নেয়নি। তাহলে টেন্ডার নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হবে কেন? আমাদের মধ্যে মূল বিরোধ হচ্ছে, আমরা দু’জনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। নাছির ভাই (আ জ ম নাছির উদ্দীন) আমাকে সভাপতি করেন আর দিয়াজকে কেন্দ্রে পোস্ট নিয়ে দেন। দিয়াজ এটা মানতে পারেনি। ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই আমাকে সভাপতি করে কমিটি ঘোষণা হয়। এরপর থেকে দিয়াজ বিভিন্নভাবে আমার বিরোধিতা শুরু করে।’

দিয়াজের বাসায় হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সহ-সভাপতির গ্রুপের এক ছেলের আঙ্গুল কেটে দেয় দিয়াজের ছেলেরা। সহ-সভাপতির জুনিয়র ফলোয়ার ছিল ২০০-৩০০ জন আর দিয়াজের ছিল ৩৫-৪০ জন। সহ সভাপতির গ্রুপ প্রতিশোধ নিতে তার বাসায় হামলা করে। এখানে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।’

তবে তদন্তে টেন্ডার নিয়ে বিরোধের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়ে এএসপি আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে দিয়াজ ইরফানের সঙ্গে অনেকের ভুল বোঝাবুঝি হয়। অনেকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। এটা বড় আকার ধারণ করেছিল।’

জবানবন্দিতে দিয়াজের বান্ধবীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নভেম্বরের ১৬-১৭ তারিখের দিকে দিয়াজ ও তার এক বন্ধু এবং তারা দুই বান্ধবী মিলে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে ঘুরতে যান। সেখানে দিয়াজের সাবেক প্রেমিকা দাবিদার ওই ছাত্রী তার মেসেঞ্জারে নক দিয়ে দুই লাখ টাকা ফেরত দাবি করেন।

এদিকে বাসায় হামলার পর থেকে দিয়াজের গ্রুপ ভেঙে যেতে শুরু করে। হাতেগোণা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই দিয়াজের গ্রুপ থেকে চলে যান। জিসান নামে একজন (পরবর্তীতে দিয়াজ খুনের মামলার আসামি) গ্রুপ পাল্টে আলমগীর টিপুর কাছে গিয়ে দিয়াজের গ্রুপের সব তথ্য প্রকাশ করে দেন। এর মধ্যে ১৯ নভেম্বর ক্যাম্পাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে টিপুর অনুসারীরা খাবার পাচ্ছে কিন্তু তার অনুসারীদের খাবারের টোকেন দেওয়া হচ্ছে না, এমন অভিযোগ করে প্রক্টরের সঙ্গে ঝামেলা করেন দিয়াজ।

আলমগীর টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিসান আমার গ্রুপে যোগ দেয়নি। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমরা চবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করি। সেখানে দিয়াজের গ্রুপের ছেলেদেরও পদ দেওয়া হয়। পদ পেয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কর্মসূচিতে যোগ দিতে থাকে। তখন দিয়াজ ভেবেছিল, তারা বোধহয় গ্রুপ চেঞ্জ করেছে। বাস্তবে এমন কিছু হয়নি।’

জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে দিয়াজ তার বান্ধবীকে নিজের বাসায় যেতে চাপ দেন। বান্ধবী অপারগতা জানান। ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট থেকে বান্ধবী অটোরিকশা খুঁজছিলেন বালছড়ায় বাসায় যাবার জন্য। এসময় দিয়াজ বান্ধবীকে তার দুই সহপাঠীকে (একজন ছাত্র, আরেকজন ছাত্রী) নিয়ে বাসায় যাবার জন্য আবার চাপ দেন। সেটা না শুনে তিনজন অটোরিকশায় উঠে বসলে দিয়াজ জোর করে চালকের পাশে গিয়ে বসেন।

বান্ধবী বারবার দিয়াজকে নেমে যেতে বলায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নেমে গিয়ে তার হাতে নিজের মোবাইল দিয়ে দেয়। তখন বান্ধবী তার সহপাঠী বন্ধুকে মোবাইলটি দিয়ে দিয়াজকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দুই বান্ধবী অটোরিকশাটি নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। কিছুক্ষণ পর সহপাঠী বন্ধুর ফোনে তারা আবার অটোরিকশা ঘুরিয়ে সেখানে আসেন। দিয়াজ কোনোভাবেই বাসায় যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। বান্ধবী তখন তার দুই সহপাঠীকে নামিয়ে দিয়ে একা বাসায় চলে যান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সহপাঠী বান্ধবী ফোন করে জানায়, দিয়াজকে অস্বাভাবিক লাগছে, সম্ভবত তিনি মদ্যপ।

তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেই রাতেই দিয়াজ বাসের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল বলে আমরা তথ্যপ্রমাণ পাই।’

জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, রাতে দুই সহপাঠী দিয়াজকে নিয়ে বান্ধবীর বাসার কাছে আসেন। সেখানে দিয়াজের একজন বন্ধুও আসেন। দিয়াজ তাকে দেখে রেগে গিয়ে থাপ্পড় দেন। ওই বন্ধুও দিয়াজকে গালিগালাজ শুরু করেন। তখন ওই বান্ধবী তার দুই সহপাঠীসহ দিয়াজকে দ্রুত তার বাসায় নিয়ে নিয়ে যান। সেখানে দিয়াজ একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল। বান্ধবীর সঙ্গে কয়েকবার ছবি তোলার আবদার করে। কিন্তু বান্ধবী রাজি হননি। এরপর দিয়াজ পরদিন তার বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা আছে জানিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা আটকে দেন।

বান্ধবী ও তার দুই সহপাঠী গভীর রাতে দিয়াজের কক্ষে গিয়ে কয়েকবার টোকা দিলেও তিনি কোনো কথা বলেননি, দরজাও খোলেননি। ভেতর থেকে মোবাইল ভাঙার আওয়াজ পান তারা। ভোর ৪টার দিকে আবারও দরোজায় টোকা দিলেও দিয়াজের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। দিয়াজ ঘুমিয়েছেন ভেবে তিনজন আরেকটি কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে তারা বেরিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে মূল দরজা বন্ধ করার জন্য দিয়াজকে ডাকেন। কিন্তু তখনও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তারা বালুচরায় বান্ধবীর বাসায় ফিরে আসেন।

সেখানে বসে তারা তাদের এক সহপাঠী বন্ধু এবং ‘বাংলার মুখ’ গ্রুপের এক সদস্যকে কল করে বিষয়টি জানান। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তারা আবার দিয়াজের বাসায় গিয়ে তাকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সহপাঠী দুই বন্ধুর মধ্যে একজন রান্নাঘরের বেলকনি দিয়ে দিয়াজের কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখেন। ফিরে এসে বলেন, ‘দিয়াজ ভাই মনে হয় আর বেঁচে নেই, আমাদের এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে হবে, শুধু দোয়া কর।’

তারা দিয়াজের বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসেন। সেখান থেকে দিয়াজের বান্ধবী তার সহপাঠী বান্ধবীর ষোলশহরের বাসায় চলে আসেন। সেখানে নামাজ পড়ে দিয়াজ যেন ভালো থাকে, সেই দোয়া করেন। রাতে ক্যাম্পাসে মাইকিং শুনে সহপাঠী এক বন্ধু দিয়াজের বান্ধবীকে জানান, দিয়াজ আর বেঁচে নেই। পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করেছে।

জবানবন্দির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সেই ছাত্রী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালতে জবানবন্দিতে যা বলেছি সেটাই আমার বক্তব্য। এর বাইরে আমি আর কোনো কথা বলতে পারবো না।

তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে হতাশার পাশাপাশি পরিবার থেকেও চাপে ছিলেন দিয়াজ। নিজের গ্রুপের ছেলেদের বেঈমানিও তাকে হতাশ করেছিল। এসব হতাশার বিষয় সে মৃত্যুর আগে ৪, ৬ ও ১১ নভেম্বর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকাশ করেছিল।’

‘এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর জবানবন্দিতে এসেছে দিয়াজের রুমের দরজা ভেতর থেকে লক ছিল। সুতরাং হত্যার বিষয় সঠিক নয়। কেউ তাকে মেরে ভেতর থেকে দরোজা বন্ধ করে বের হবে কিভাবে?’

জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা বলেন, ‘দিয়াজের কোনো হতাশা ছিল না। সে খুব স্ট্রং ছেলে ছিল। আমাদের তাকে কোনোদিন শাসন করতে হয়নি। বরং সে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতো। সে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিল। নন ক্যাডার হিসেবেও সিলেক্ট হয়েছিল। সুতরাং পারিবারিকভাবে চাপ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পক্ষে সিআইডি
লাশ উদ্ধারের পর থেকেই দিয়াজের পরিবার ও চবি ছাত্রলীগের একাংশ দাবি করে আসছিল, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। প্রতিবেদনে তাকে হত্যার আলামত মেলেনি বলে উল্লেখ করে দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে বলা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিয়াজের পরিবার।

এরপর তার মা জাহেদা আমিন চৌধুরী ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আসামিরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, চবি ছাত্রলীগের সেই সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু, ছাত্রলীগ নেতা আবুল মনসুর জামশেদ, তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমান। অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

জাহেদা আমিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত দিয়াজের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে শ্বাসরোধ ও আঘাতজনিত জখমের মাধ্যমে হত্যার আলামত আছে।

আদালতের নির্দেশে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। সেসময়কার ওসি বেলাল উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নিজেই তদন্ত শুরু করেন। পরে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডির কাছে। সিআইডির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার অহিদুর রহমান তদন্ত শুরুর পর বদলি হন। এরপর থেকে আরও দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়ে সর্বশেষ সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুস সালাম মিয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

এএসপি আব্দুস সালাম মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সপক্ষেই আমরা সব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সপক্ষে কিছু পাওয়া যায়নি। সেই প্রতিবেদন কেন দেওয়া হয়েছিল সেটা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আদালতে জবাব দেবেন।’

মামলার আসামিদের একজন আলমগীর টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল, সবই মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। একটা মিথ্যা অভিযোগ আমরা সাত বছর ধরে বহন করেছি। একটা আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়েছে।’

মামলার বাদি জাহেদা আমিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আদিষ্ট প্রতিবেদন। প্রভাবিত হয়ে দিয়েছে সিআইডি। না হলে আমি বাদি জানার আগে আসামি প্রতিবেদন সম্পর্কে জেনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। আমরা প্রতিবেদন পাবার পর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে নারাজি আবেদন দাখিল করবো।’

সারাবাংলা/আরডি/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন