বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো নীতি আদর্শ নেই

March 3, 2023 | 6:55 pm

জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো নীতি আর্দশ বা রাজনীতি নেই। দলটি ক্রমান্বয়ে ভাঙনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকেই দলটির মধ্যে জগাখিচুরির মধ্যদিয়ে চলছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতায় থাকাবস্থায় খেতাব পান তিনি স্বৈরাচার হিসেবে। ১৯৯০ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। এরপর দীর্ঘ ৩০ বছর পর গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা হয়ে তিনি মৃত্যবরণ করেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়ার পর জাতীয় পার্টি এরশাদের জীবদ্দশাতেই পাঁচ-পাঁচ বার ভেঙেছে দলটি। প্রথমবার ভেঙেছিলেন চক্ষু ডাক্তর এমএ মতিন। দ্বিতীয়বার ভাঙেন কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেম এবং এই দুজনার পার্টির নাম হয় জাতীয় পার্টি (জা-মো)।

তৃতীয় ও চতুর্থবার জাতীয় পার্টি ভাঙেন দুই মঞ্জু। এর মধ্যে নাজিউর রহমান মঞ্জু এরশাদের মুক্তির জন্য ভিক্ষা করতেও রাজি ছিলেন। সেই তিনি ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের বেশ আগেই এরশাদের দল ভেঙে চারদলীয় অর্থাৎ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন। তার মৃত্যুর পরে তার পুত্র আন্দালিব পার্থ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গেই আছেন। আর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টি ভেঙে একলা চলার নীতি নিয়েছেন। এরশাদের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় আবার ভাঙনের মুখে পড়েছে দলটি। এই ভাঙনে সৃষ্টি হতে পারে জাপা রওশন জাপা কাদের।

জাতীয় পার্টি সৃষ্টি হয় বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের ক্ষমতা দখলের তিনদিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী। এরশাদ মূলত ক্ষমতা দখলের পর থেকেই রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছিলেন। তারই ইচ্ছায় ২ নভেম্বর ১৯৮৩ আহসানউদ্দিন চৌধুরী ‘জন দল’ গঠন করেন। এরশাদ বিএনপির ১৯ দফার আদলে নতুন করে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একপর্যায়ে আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলে ‘জন দল’ থেকে সরে দাঁড়ান আহসানউদ্দিন চৌধুরী। ‘জন দলে’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মিজানুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা। দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা চালান এরশাদ। প্লাটফর্মটির নাম ছিল জাতীয় ফ্রন্ট।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি নেতা শাহ আজিজের নেতৃত্বে একটি অংশ, জন দল, গণতন্ত্রী দল, কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, মওদুদ আহমদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় ফ্রন্টে যোগ দেন। ১ অক্টোবর ১৯৮৫ এরশাদ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এর কয়েক মাসের মাথায় আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সংসদীয় নির্বাচনের আয়োজন করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোটকে নির্বাচনে আহ্বান করেন এরশাদ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের পাঁচ দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নেয়নি। ৭ মে ১৯৮৬-এর সেই বিতর্কিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি ও আওয়ামী লীগ ৭৩টি আসন পায়। ৩ মার্চ ১৯৮৮ আবারও নির্বাচনের আয়োজন করেন এরশাদ। এ নির্বাচনে অবশ্য আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। ৩ মার্চ ১৯৮৮-এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টি একাই ২৫১টি আসন পায়।

১৯৮৯ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ’৯০-এর ডিসেম্বরে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি ৩৫টি আসন পায়। বাংলাদেশের প্রধান দুই দল এরশাদের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করলেও নির্বাচনে জাতীয় পার্টি দুই দলের কাছেই খুবই তুরুপের তাস। এরশাদ ও তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে দলে টানতে দুই দলেরই তৎপরতা দেখা যায়। তবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরেছে দুবার।

২০০১ সালে জাতীয় পার্টি ভেঙে বেরিয়ে গেছেন এরশাদের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাজিউর রহমান মঞ্জুর। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে যান কাজী জাফর। তিনি এখন অপর একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

দলটিতে মহাসচিব পদটিও আতংকের। কখন কে মহসচিব হন আবার কখন বাদ পড়বেন তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। সকালে মহাসচিব হয়ে গেলেন। রাতে ঘুমালেন সকালে উঠে দেখলেন তার পদ নেই। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় পার্টিতে সব মহাসচিবই একই কায়দায় এসেছেন এবং বিদায় নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ছিলেন ডা. আবদুল মতিন, যিনি জিয়া ও সাত্তারের সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তিন বছর পর মতিনকে সরিয়ে এ পদে আনা হয় অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানকে। এরপর আসেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। ১৯৯০ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে এরশাদ তাঁকে সরিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে মহাসচিব করেন; তিনি নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় বিরোধী দলের পদত্যাগের দাবির জবাবে বলেছিলেন, ‘পদত্যাগপত্র কি জিরো পয়েন্টে দিয়ে আসা হবে?’

১৯৯২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শাহ মোয়াজ্জেম মহাসচিব ছিলেন। এরশাদ কারাবন্দি অবস্থায় প্রথমে চিরকুট পাঠিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে সরিয়ে খালেদুর রহমান টিটোকে এবং পরে তাঁকে বাদ দিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব পদে বসান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জাতীয় পার্টি তাতে যোগ দেয় এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী হন। এরশাদও কারামুক্ত হন। তবে সরকারে থাকা না-থাকা নিয়ে জাতীয় পার্টিতে তখন মতভেদ ছিল। একপর্যায়ে এরশাদ সরকারে না থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং মঞ্জুকে পদত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু মঞ্জু তার সিদ্ধান্ত অমান্য করে আলাদা জাতীয় পার্টি করেন।

এরশাদের পরবর্তী মহাসচিব হন নাজিউর রহমান মঞ্জুর। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া প্রশ্নে দলে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব হন এ বি এম শাহজাহান। এর দুই বছর পর তাকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তিনি ১২ বছর এই দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৪ সালে হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব করা হয়। কয়েক বছর পর বাবলুর স্থলে ফের আসেন রুহুল আমিন হাওলাদার। কিন্তু গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাঁকে সরে যেতে হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, তিনিও বেশিদিন থাকতে পারেননি মহাসচিব পদে। তাকে সরিয়ে এই পদে আনা হয় মুজিবুল হক চুন্নুকে। এবার তারও মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সানাই বেজে উঠেছে।

স্বৈরাচার থেকে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হয়ে তিনি মৃত্যু বরন করেন। তবে এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির ৪ টি ভাগ রয়েছে। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, অপর দুটির নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান পার্থ ও কাজী জাফর আহমেদ। বিদিশা নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুর্ন গঠন জাতীয় পার্টির।

বিজ্ঞাপন

১৯৯০ সালে ক্ষমতা হারানোর পর সবচেয়ে বেশি দ্বৈত অবস্থানে চলে যায় জাপা।কথা দিয়ে কথা না রাখা কিংবা কথা বদলে ফেলার ফেলে বেশি ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এসময়ে এরশাদ সকালে ঘোষণা দিতেন আওয়ামী লীগের অধীনে একতরফা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কিন্তু রাতের বেলা সেটা আবার বদলে ফেলতেন। আবার এও বলতেন এরশাদ নির্বাচনে না গেলে সংবিধানের বরখেলাপ হবে আবার নির্বাচনে অংশ নিলে মানুষ আমার (এরশাদের) মুখে থুথু দেবে।

এরশাদ হঠাৎ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন এবং তার দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর চিকিৎসার নামে এরশাদকে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আর পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে ভিন্ন ভূমিকায় নেমেছিলেন রওশন এরশাদ। এর ফলে যারা এরশাদের কথায় মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। জাতীয় পার্টির আর যেসব সদস্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি তারা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন এবং ৩৪টি আসন লাভ করেন। এরশাদ বলতে পারেন জাতীয় পার্টি সংকটে আছে তবে মহাসংকটে নেই। এখন তার ছোট ভাই বলেন জাতীয় পার্ট এরশাদ আমলের চেয়েও এখন বেশি শক্তিশালী।

খেতাবের দিক থেকেও দলটির এগিয়ে। এরশাদকে তার দলের লোকজন দিয়েছেন পল্লী বন্ধু। কিন্তু এই খেতাব জনগণের মাঝ থেকে আসেনি। খেতাবটি তার প্রেসইউং থেকে দেওয়া হয়েছিল। তার ছোট ভাই জিএম কাদেরেরও প্রেস উইং থেকে খেতাব দেওয়া হয়েছে জনবন্ধু। এই খেতাব নিয়ে দলের নেতা-কর্মদের মুখে শোনা গেছে তিনি জনগণের জন্য এমন কি কাজ করেছেন যে সে জনবন্ধু হলেন?

সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠান বা দলই বড় হয়ে থাকে। পার্টি দিন দিন ছোট হচ্ছে। দলটির কোনো নিজস্ব আদর্শ নীতি ও রাজনীতি নেই। দলের চেয়ারম্যান যা বলবেন সেটিই জাতীয় পার্টির জন্য আইন কানুন। তিনিই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না। গঠনতন্ত্র ভঙ্গেও অভিযোগে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে আদালতে রয়েছে চারটি মামলা। আসলে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল নয়। নিজেদের কোনো অবস্থান নেই। ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এমনকি দলটির হেভিওয়েট প্রার্থীরাও একক ভাবে নির্বাচিত হতে পারবেন না। তাদের যে কোনো জোটে গিয়ে নির্বাচন করতে হবে।

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন