বিজ্ঞাপন

মামলা হয়নি ৩ দিনেও, ডিসির সঙ্গে মিটিংয়ে প্ল্যান্ট মালিক

March 6, 2023 | 8:34 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণের তিনদিনেও মামলা দায়ের হয়নি। মামলার বাদী কে হবে- পুলিশ নাকি হতাহত কারও পরিবার এবং আসামি কাদের করা হবে এ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় আছে পুলিশ। এদিকে শিল্পপ্রবণ এলাকায় দুর্ঘটনা হ্রাস নিয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের ডাকা এক জরুরি সভায় যোগ দেন ওই অক্সিজেন কারখানার মালিক মো. মামুন উদ্দীন।

বিজ্ঞাপন

তিন দিনেও মামলা দায়ের না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) সুদীপ্ত সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত (রোববার) রাতে আরও একজনের মৃত্যু হওয়ায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সর্বশেষ নিহত ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ও তথ্য সংগ্রহ করে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সেটা সংগ্রহ করতে একটু সময় লাগছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের হয়ে যাবে।’

সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনা, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে কি না এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতনদের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। আমাদের চেষ্টা ভিকটিমের পরিবারের কাউকে দিয়ে মামলা দায়েরের। মামলার আসামি কার হবেন, মালিকপক্ষের দায় কতটুকু, যারা প্ল্যান্টটি পরিচালনা করছিলেন তাদের দায় কতটুকু- এসব বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটু সময় লাগছে। তবে আজ (সোমবার) রাত ১২টার আগেই যাতে মামলা দায়ের হয়, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের আছে।’

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৪ মার্চ) বিকেলে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি ইউনিয়নের ছোট কুমিরায় সীমা শিল্পগ্রুপের প্রতিষ্ঠান সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড কারখানায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। এতে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ১৯ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিহতরা হলেন- শামসুল আলম (৫০), ফরিদ (৩৬), রতন লকরেট (৪৫), আব্দুল কাদের (৫০), সালাহউদ্দিন (৩৫), সেলিম রিচিল (৩৮) এবং প্রবেশ লাল শর্মা (৫৫)।

বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন নিভিয়ে শনিবার রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিস কারখানায় উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করে। রোববার বিকেলে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তদন্ত কমিটির সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার কারখানার মালিকপক্ষ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছিলেন।

এ অবস্থায় সোমবার (৬ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ‘চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্প প্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের’ জন্য মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। সভায় উপস্থিত হয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের প্রশ্নের মুখে পড়েন সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেড কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দীন।

বিজ্ঞাপন

সভার শুরুতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানতে চান কত সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে, কত শ্রমিক কাজ করতেন এবং কী উৎপাদন হতো। এছাড়া এত লোকজন কীভাবে হতাহত হলো- এসব বিষয় মামুনের কাছে জানতে চান। জবাবে মামুন উদ্দীন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত। আমার বাবা আহমদ শফী প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে চালু আছে। সরকারি সব কমপ্লায়েন্স মেনেই কারখানাটা চালু রেখেছি। কী কারণে হঠাৎ করে পরশু দিন ব্লাস্ট হয়েছে আমরা এখনো… ইয়ে করতে পারতেছি না। তদন্ত কমিটি গতকাল পরিদর্শন করে এসেছে। উনারা তদন্ত করলেই আসল কারণটা বুঝতে পারবেন।’

‘বিস্ফোরণের সময় ১৪-১৫ জন শ্রমিক ছিল। ২ জন অপারেটর ছিল। এডমিনের দু’জন ছিল। একজন সুপারভাইজার ছিল। সব মিলিয়ে ১৯ জন। তবে আহতদের মধ্যে অনেক পথচারী আছেন।’ কারখানায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন উৎপাদন হতো বলে তিনি জানান।

এরপর জেলা প্রশাসক তাদের কারখানা পরিচালনায় নিয়োজিত প্রকৌশলীদের বিষয়ে জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘অপারেটররা ডিপ্লোমা হোল্ডার। উনারা ২৭ বছর ধরে ওই প্ল্যান্টটা চালাচ্ছেন। সেজন্য এক্সপেরিয়েন্স আছে।’ কীভাবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো দুর্ঘটনা। এটাতে কারও হাত নেই। কেন হয়েছে জানি না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালো বলতে পারবেন এটা কীসের কারণে হয়েছে।’

সভায় শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সোলায়মান তার উদ্দেশে বলেন, ‘প্ল্যান্টটি চায়না থেকে ইমপোর্ট করা। ইন্সটলেশনের পর প্রকৌশলীরা আর কখনো এসেছিলেন? আপনারা কিভাবে মাত্র দু’জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক থেকে পাস করা একজন স্টুডেন্ট (সুপারভাইজার) দিয়ে একটা অক্সিজেন প্ল্যান্টটি চালাচ্ছেন?’

বিজ্ঞাপন

জবাবে মামুন উদ্দীন বলেন, ‘চীন থেকে সাপ্লাই দেওয়ার পর কমিশনিং এবং প্রডাকশন পর্যন্ত প্রায় তিন মাস উনারা এখানে ছিলেন। এরপর আরও দু’মাস থেকে যারা অপারেটিং করবে তাদের ট্রেনিং দিয়েছে। তারপর আর আসেননি। উনারা প্রায় (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও সুপারভাইজার) ২০ বছর ধরে চালাচ্ছিলেন।’

সভায় সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘ঘটনার দিন যার অক্সিজেন কলাম পরিচালনার কথা ছিল সে অনুপস্থিত ছিল বলে জানতে পেরেছি। অন্য একজনকে দিয়ে সেটি চালানো হচ্ছিল। এভাবে দক্ষ লোকের পরিবর্তে অন্যদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালে কি হয় তা তো দেখাই যাচ্ছে। সাতজনের প্রাণ গেছে। যার গেছে সে জানে।’

কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরের চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বলেন, ‘আমরা ইতোপূর্বে পরিদর্শন করে অনেক প্রবলেম পেয়েছিলাম। তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিই। পরে ডিসেম্বরে আবার পরিদর্শনে যাই। তখন মালিকপক্ষ তিন মাস সময় চান। তিন মাস পর চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ফের পরিদর্শনের কথা ছিল। কিছু তারা সংশোধন করেছিল। কিন্তু বাকিও ছিল। তাছাড়া তাদের সীমা অটো রি-রোলিং মিলেও আমরা ফল্ট পাই। শ্রম আদালতে মামলা করি। সেখানে সব পরিপূর্ণ করার আশ্বাস দিয়ে তারা আসে।’

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক জানান, ২০২২ সালে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ফায়ার সেফটি প্ল্যান্ট করার কথা বললেও তারা বাস্তবায়ন করেনি। বিস্ফোরক অধিদফতরের পরিদর্শক এস এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ওখানে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার ছিল। এসব সিলিন্ডারে তারা অক্সিজেন ফিলিং করে। এর কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। অদক্ষ লোক দ্বারা প্ল্যান্ট পরিচালনা করা হয়। সেফটি ভাল্ব বা চেকআপের কাগজ দেখাতে পারেনি।’

এ সময় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের এমডি মামুন উদ্দীন বলেন, ‘মেনটেইনেন্স কাজে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার লাগে। আগে নাইট্রোজেন উৎপাদন করতাম। এখন গত ছয় মাস করি না। সিলিন্ডার রয়ে গেছে।’ কম বেতনে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে কারখানা পরিচালনার অভিযোগ মামুন উদ্দীন অভিযোগ অস্বীকার করেন। সভা শেষে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেডের এমডি দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যান।

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে শুধুমাত্র অগ্নিনির্বাপণ নিয়ে নয়টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। জরিমানা করেছি, এক বছরের জেল পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। একটা লক্ষ্য ছিল, এখানে যাতে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে। কিন্তু দুঃখজনক হলো যেসব প্রতিষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের টিম অভিযান পরিচালনা করেছে সেসব প্রতিষ্ঠানে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না।’

মহাপরিকল্পনায় দুর্ঘটনা হ্রাস, পরিবেশের দূষণ রোধ, খাল-নদী রক্ষা, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি ও পাহাড় কাটা রোধ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও মালিকদের মূলধনের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সীতাকুণ্ডে বাস্তবায়ন, পাশাপাশি কর্ণফুলী, আনোয়ারা, মীরসরাই, হাটহাজারী উপজেলার জন্য প্রণয়নের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) রাকিব হাসানের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় সীতাকুণ্ডের উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন, জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহাদাৎ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন