বিজ্ঞাপন

বৈকালীন চেম্বার উদ্বোধনের দিনেই সেবা না পেয়ে ফিরে গেল রোগী

March 30, 2023 | 11:35 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ফেনী থেকে: ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মূল গেইট। বাইরেই একটা ব্যানার ঝুলানো রয়েছে। ব্যানারে বৈকালিক প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা ফি’র বিষয়ে লেখা। বিকেল ৫টার কিছু আগে সেই ব্যানার পড়ছিলেন সেবা নিতে আসা রাসেল ইসলাম নামে এক রোগী।

বিজ্ঞাপন

এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘সকালে হাসপাতালে আসার কথা থাকলেও পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। পরে এখানকার একজন জানান, সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নাকি নতুন সেবা চালু হইছে হাসপাতালে। বড় ডাক্তারদের নাকি কম খরচে দেখানো যাবে। কিন্তু একটু আগে একজন জানাল, ডাক্তার নাকি ৪টার দিকেই চলে গেছেন। একটু আগে গিয়ে দেখলাম, যেখানে রোগী দেখবে সেখানকার গেইটে তালা দেওয়া। অথচ এখন বাজে বিকেল সোয়া ৫টা মাত্র। কাউরেই পেলাম না।’

বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সরেজমিনে এমন পরিস্থিতি দেখা যায় ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। এদিন নির্ধারিত সময় বিকেল ৩টার কিছু আগেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বা বৈকালীন চেম্বার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের চিকিত্সক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত থেকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ সেবার মাধ্যমে দেশের জনগণ বিকেল ৩টার পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাবে। ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং কনসালটেন্ট তাদের নিজ হাসপাতালে বসে রোগী দেখবেন। রোগীর কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে সেগুলোও করা হবে।’

তবে সরেজমিনে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে দেখা গেলো ভিন্ন পরিস্থিতি। উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপরেই একে একে চলে যান সবাই। চারজন রোগী এদিন প্রথম ঘণ্টায় চিকিৎসা নিলেও এরপরে যারা আসে তাদের ফিরে যেতে হয়।

বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের পরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারী থাকলেও ছিলেন না কোনো চিকিৎসক। এর পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের রুমে দেখা যায় তালা দেওয়া। আবু বকর নামে এক ওয়ার্ড বয়কে কিছুক্ষণ বসে থাকতে দেখা যায়। তবে তার একটু পরেই বিকেল পাঁচটার আগে কনসালটেন্ট ব্লকের গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

এদিন উদ্বোধনের পরে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের বৈকালীন চেম্বারে চার জন রোগী চিকিৎসা নেন। হাসপাতালের অর্থো সার্জারির মেডিক্যাল অফিসার ডা. ফৌজুল কবীর প্রথম একজনকে চিকিৎসা সেবা দেন। এরপর মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. মো. জামাল উদ্দিন দুই জন ও মেডিক্যাল অফিসার ডা. শামিমা সুলতানা একজন রোগীকে চিকিৎসা দেন।

এখানে চিকিৎসা নিতে আসা ২৮ বছর বয়সী মো. রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রামগড় থেকে রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসা হয় ভর্তি করানোর জন্য। কারণ, রোগী হাসপাতালে ভর্তির পরে রাউন্ডে আসা চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। পরে উদ্বোধন কার্যক্রম দেখে সেখানে চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়ার কথা ভাবি। তাই হাসপাতালে যে ভর্তি আছে তাকে আবার এই চেম্বারেও দেখালাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পরে কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিল। কিন্তু দেরিতে আসার কারণে হাসপাতালে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো সম্ভব হয়নি। বিকেলের চেম্বারে চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা নিতে গেলে দেখা যায়, সেখানেও কয়েকটি শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সময় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে সেই টেস্টগুলো হাসপাতালে করা যাবে না বলে জানান তিনি।’

বিজ্ঞাপন

রুবেল বলেন, ‘বলেছে আজ টেস্ট করানো যাবে না। কাল শুক্রবার, তাই বন্ধ। শনিবার টেস্ট করাতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। সেজন্য বাইরে থেকেই হয়তো করাতে হবে।’

এর আগে, ঘড়ির কাটায় যখন ঠিক ৩টা তখন হাসপাতালে প্রবেশ করেন এই প্রতিবেদক। হাসপাতালের মূল গেইট ও প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি বহির্বিভাগের সামনে বৈকালীন চিকিৎসা দেওয়া বিষয়ে ব্যানার দেখা যায়। তবে সেই সেবা কোথায় দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা ছিল না। শুধুমাত্র চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত মূল্যের কথাই উল্লেখ করা হয় সেই ব্যানারে।

তবে জরুরি বিভাগে খোঁজ করে জানা যায়, প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলার কনসালটেন্ট ব্লকের ৬২৫ নম্বর কক্ষকে বৈকালীন চেম্বারের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই কক্ষে পৌঁছানোর পরে দেখা যায়, সেখানে উপস্থিত হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজীসহ অন্যান্য চিকিৎসকরা।

এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের ডা. মিয়াজী বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আজ এই বৈকালীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন করেন। সেখানে আমরাও জুমের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিলাম। আমরা এই সেবা দেওয়ার জন্য একটা কক্ষ নির্ধারণ করেছি। ফিতা কাটার মাধ্যমে আমাদের এখানেও এই সেবা উদ্বোধন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে কোন দিন কারা চিকিৎসা দেবেন সেই বিষয়ে একটা রোস্টার করা হবে। এরপরে এই সেবা বিষয়ে জনগণের কাছে যেন প্রচার করা যায় সেই ব্যবস্থাও নেব। আমরা এখন যে সেবাগুলো দিচ্ছি তা অক্ষুন্ন রেখেই সক্ষমতার আলোকে দ্রুত সম্প্রসারণের চেষ্টা করব।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে প্রচার-প্রচারণা বেশি করতে না পারায় প্রথম দিন হিসেবে রোগীর সংখ্যা কম কিছুটা। কিন্তু ধীরে ধীরে এটাও বাড়বে।’ হাসপাতালেই প্যাথলজিক্যাল নানা রকমের টেস্ট করানো হবে বলেও জানান ডা. মিয়াজী।

তিনি বলেন, ‘এটা নীতিমালার মধ্যেই আছে। এ বিষয়ে ফিও নির্ধারণ করা আছে। আর তাই আমরা চেষ্টা করব। আমাদের জনবল সংকট আছে। যদি আমরা দেখি যে, বর্তমানে যে জনবল আছে তা দিয়ে সকালের পাশাপাশি বিকেলেও সেবা দেওয়া যায়— তবে সেটা করব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ সংকট আছে। সেক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনীয় জনবল অবশ্যই চাইব। ২৫০ শয্যায় রূপান্তর হওয়ার পরে এখন কিছু কনসালটেন্টের পদও খালি আছে। সব মিলিয়ে আমরা সকালে যে সেবা দিচ্ছি তা ধরে রেখে সামর্থ্য অনুযায়ী বিকেলেও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া চেষ্টা করব।’

ঘড়ির কাঁটায় যখন ৩টা ৫৪ মিনিট তখন ডা. মিয়াজী হাসপাতাল ত্যাগ করেন। বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে রুবেল মিয়াকে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. মো. জামাল উদ্দিন। বৈকালীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য নতুনভাবে বানানো একটি প্যাডে তিনি রুবেল মিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নির্দেশনা দেন। আর তার একটু পরে তিনি চলে যান।

বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে বৈকালীন চেম্বারের জন্য নির্ধারণ করা কক্ষে আবু বকর নামে একজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। এ সময় তিনি জানান, রোগী এলে হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. শামিমা সুলতানাকে ডাক দিতে বলা হয়েছে। তিনি তার কক্ষেই আছেন। পরে তিনি বলেন, ‘আমাকে আরেকটা বিভাগ থেকে এখানে এসে বসতে বলা হয়েছে। আর তাই বেশি কিছু বলতে পারব না।’

এ সময় হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. শামিমা সুলতানার ৬০৫ নম্বর কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায় দরজায় তালা লাগানো। তার একটু পরেই অর্থাৎ বিকেল ৪ টা ৫২ মিনিটের দিকে বৈকালীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ধারিত কক্ষে তালা দিয়ে অন্যদের চলে যেতে দেখা যায়। বিকেল ৫ টার পরে কনসালটেন্ট বিভাগের সামনেই থাকা গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও তেমনটা হয়নি কেন?— এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) বিকেল ৩টায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে, ‌‘সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের বৈকালিক চেম্বার’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ১২টি জেলায় এবং ৩৯টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করতে যাচ্ছি। এ সেবার মাধ্যমে দেশের জনগণ বিকেল ৩টার পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবা পাবে। ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং কনসালটেন্ট তাদের নিজ হাসপাতালে বসে রোগী দেখবেন। রোগীর কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে সেগুলোও করা হবে।’

উদ্বোধনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের চিকিত্সক, সংসদ সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত থেকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন।

প্রসঙ্গত, এর আগে গত ২২ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয়ের সাথে বিভিন্ন চিকিৎসক পেশাজীবী সংগঠনসহ, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘ইনস্টিটিউশনাল প্রাকটিস বিষয়ক একটি জরুরি সভায়’ নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে ১ মার্চ থেকে নিজ কর্মস্থলেই সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার ঘোষণা দেন, যদিও ঘোষিত দিনে তা শুরু করা যায়নি।

পরবর্তী সময়ে সোমবার (২৭ মার্চ) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে বৈকালিক চেম্বার বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ৩০ মার্চ থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জানা গেছে, এই সেবার জন্য একজন অধ্যাপকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন, সেবার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা এবং হাসপাতাল পাবে ৫০ টাকা। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক বা সিনিয়র কনসালটেন্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। এর মাঝে চিকিৎসক পাবেন ৩০০ টাকা। সহকারী অধ্যাপক বা জুনিয়র কনসালটেন্ট, বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা, যার ২০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। এমবিবিএস বা বিডিএস বা সমমনা ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৫০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। বাকি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কাটা হবে এবং চিকিৎসকদের সহায়তাকারীরা পাবেন। এক্ষেত্রে নার্স ও টেকনিশিয়ানরাও সপ্তাহে দুদিন করে কাজ করবেন।

আরও জানা গেছে, লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে ছোট সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি ৮০০ টাকা এবং সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি এক হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন