বিজ্ঞাপন

উত্তরাধিকার আইন, হাঁটতে হবে বহুদূর

April 28, 2023 | 4:55 pm

আফসানা কিশোয়ার

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) ধারা অনুযায়ী ‘নারী ও পুরুষের অধিকার সমান’। আইন অনুযায়ী যা বলা হয়েছে বাস্তবে কি সেই অধিকার সমান? সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পুরুষ কতটুকু সম্পত্তি কি শর্তসাপেক্ষে পাবে এ নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেখা যায় না; অথচ নারী কি পাবে, কেন পাবে আদৌ কোন সম্পদ পাওয়ার যোগ্য কি না সে নিয়ে আমরা বিবিধ ভাগ দেখতে পাই।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরে বহু নতুন আইন প্রবর্তিত হয়েছে, হয়েছে আইনের এমন কী সংবিধানেরও সংশোধন! কিন্তু উত্তরাধিকার আইন ধর্মীয় পারিবারিক আইনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ আছে – সব ধর্ম নির্বিশেষে।

আমরা জানি উত্তরাধিকার হলো মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উপর তার সন্তানদের ও আত্মীয় স্বজনের অধিকার। আমাদের দেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর, সাথে আদিবাসীদেরও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধি বিধান ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের অর্ধেক পাবে কন্যা। পিতা যদি উইল না করে মারা যান তাহলে এ আইন প্রযোজ্য। এখানে প্রশ্ন থেকে যায় পিতার একমাত্র সন্তান যদি কন্যা হয় এবং তিনি যদি তার সম্পদ হেবা করে যান কন্যার নামে তখন কি হবে?ধর্ম অনুযায়ী কি পিতা কোন অধর্মের কাজ করলেন? উত্তর হলো ‘না’।’

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সমাজে চলমান যে মানসিকতা তা হচ্ছে নারীকে বঞ্চিত করার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। তাই সমগ্র দেশের অন্যান্য কাজের জন্য ‘সিভিল’ ল থাকলেও সম্পত্তির উত্তারধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, বিয়ে ইত্যাদি ক্ষেত্র যা নারীর অধিকারের সাথে সম্পর্কিত সেখানে আমাদের ধর্মীয় বোধ ভীষণ জাগ্রত হয়ে ওঠে।

এখানে যে উদাহরণ দিলাম, সন্তান যদি একজন হয় এবং সে যদি কন্যা হয় তাহলে সম্পূর্ণ সম্পত্তি হেবা করতে গেলে সম্পত্তিতে অন্যান্য যেসব শরীক আছেন তাদের অনুমতি লাগবে, মুসলিম ল অনুযায়ী। আমাদের আপত্তির জায়গা এখানেই -পুত্রকে হেবার ক্ষেত্রে যদি অন্য শরীকদের অনুমতি আবশ্যক না হয়, তাহলে কি কারণে কন্যার জন্য এ বাঁধা এসে দাঁড়ায়!

এখানে তাত্ত্বিকরা বলে বসেন কারণ বিবাহিত কন্যা স্বামীর সম্পদও পেয়ে থাকেন। সম্পদের সুষম বণ্টন রক্ষার জন্যই নারীর ক্ষেত্রে পুত্রের অর্ধেক পাবার বিধান। বাস্তবে কি তাই ঘটে? বাংলাদেশে মোট সম্পদের শতকরা সাত ভাগের মালিকানা নারীর অধিকারে আছে। এ হিসাব থেকেই বুঝা যায় নারী আসলে কিভাবে ও কতভাবে বঞ্চনার শিকার।

বিজ্ঞাপন

হিন্দু পারিবারিক আইন তো আরও মধুর। বাংলাদেশে হিন্দুদের দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কোন ব্যক্তি যদি স্ত্রী ও সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন সনাতন ধর্মের, তাহলে তার সম্পদ তার স্ত্রী ভোগদখল করবেন, মালিকানা পাবেন না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেই সম্পদ পুরুষ উত্তরাধিকারের হাতে চলে যায়। ২০১২ সালে হিন্দু আইনের বিবাহ বিচ্ছেদ, বিবাহ নিবন্ধন, ভরণপোষণ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, দত্তক নেওয়া ইত্যাদি প্রশ্নে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করা হলেও হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের আপত্তির মুখে আর কোন অগ্রগতি সাধন হয়নি।

হিন্দু নারীদের যেহেতু বিবাহ রেজিস্ট্রি হয় না, শুধু অগ্নিসাক্ষী রেখে সাতপাকে বিয়ে সম্পন্ন হয় এবং সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার নেই তাই হিন্দু নারী অত্যাচারিত হলেও তার পক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ প্রাপ্তি এক দীর্ঘযাত্রা। বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে তাকে সিভিল কোর্টে মামলা করতে হয়, চলে মামলার শুনানি। বিচারক যদি প্রমাণ সাপেক্ষে মনে করেন যে বিবাহবিচ্ছেদ দেবেন তাহলে বিচ্ছেদ হবে, অন্যথায় হবে না। অথচ বিশ্বের আধুনিক দেশগুলোতে বিবাহ করা যেমন লিঙ্গ নির্বিশেষে অধিকার তেমনি, বিবাহবিচ্ছেদ প্রাপ্তিও নাগরিকের অধিকার।

বাংলাদেশে বৌদ্ধরা হিন্দু পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেন।

খ্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীরা সাকসেশন এক্ট ১৯২৫ এর মাধ্যমে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেন। এই এক্টের আওতায় মৃত ব্যক্তির জীবিত পুত্র ও কন্যা সম্পদের সমান উত্তরাধিকার।

বিজ্ঞাপন

নৃ-গোষ্ঠীদের ভেতর পিতা মাতা ও স্বামীর সম্পদের মালিকানায় উত্তরাধিকারের কোন পদ্ধতি নেই। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পাস ও প্রয়োগ সঠিকভাবে হলে হয়তো নারীরা কিছুটা সুফল পেতে পারেন।

নারী ও পুরুষ ভিন্ন অন্য লিঙ্গের সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলামী আইন অনুযায়ী যার ভেতরে পুরুষালী শারীরিক গঠন ও স্বভাব থাকবে সে পুরুষ হিসেবে পরিগণিত হবে, নারী স্বভাব প্রকট হলে সেই হিসাবে সম্পদ পাবেন।

এত আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে অনেক কাজ করতে হবে। প্রচলিত সব ধরনের ধর্মীয় আইনকে দেশের সকল নাগরিককে সমান গণ্য করে, একটি একক সিভিল আইনের আওতায় আনতে হবে। মানুষ যখন জানে তার দেশে হত্যার জন্য সবাই একই ধরনের বিচারের আওতায় আসবে তখন তা নিয়ে কোন দ্বন্দ্বের আর অবকাশ থাকে না। তেমনি সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও একমুখী একটি আইন সোয়া একবিংশ শতাব্দীতে আর দাবী করার বিষয় হিসেবে থাকে না, সেটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিক্রিয়া দেখানোর চাইতে ক্রিয়া যত হবে ততো বেশি সামনে এগোনোর পথ মসৃণ হবে। তেমনি একটি আশাব্যঞ্জক খবর আমরা সম্প্রতি দেখেছি –
“সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য নিরোধে নতুন একটি আইনের প্রস্তাব ১৯ এপ্রিল ২০২২ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। সংবিধানের আলোকে সব ধরনের বৈষম্য নিরোধে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘বৈষম্য বিরোধী বিল-২০২২’ শীর্ষক এই বিল উত্থাপন করেন। “

নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের সাথে একটি দেশের উন্নতির চাবিকাঠি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সে পথে অগ্রগতি চাইলে যত বেশি নারীর হাতে সম্পদ আসবে ততো বেশি তার অর্থনৈতিক বৈষম্যের পথটি হ্রাস পাবে। সেজন্য আমাদের আশা এই বৈষম বিরোধী বিল -২০২২ অচিরেই পাশ হবে। সিভিল ল অনুযায়ী সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণিত হবে এবং নারী অধিকার প্রশ্নে সূচকের তালিকায় বাংলাদেশ নিজেকে এগিয়ে নেবে।

লেখক: কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন