বিজ্ঞাপন

ঢাকায় নজরুল

May 25, 2023 | 1:53 pm

বিপুল জামান

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কর্মস্থল ছিল কলকাতা। কলকাতাতেই তার পরিবার থাকতো; সেখানেই ছিল তার বন্ধু, কর্মক্ষেত্র। কবি ঢাকায় প্রথম আসেন ১৯২৫ সালের ৪ জুলাই। তরুণদের অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি বক্তৃতা দেন, গান ও কবিতা শোনান। ঢাকার সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর বিভিন্নবারে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, সিলেটে এসেছেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৪২ সালের শেষের দিকে কবির অসুস্থতা ধরা পড়ে। সে অসুস্থতা আর কাটেনি। সেভাবেই তিনি ছিলেন কলকাতায়। অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক আগ্রহে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তিনি শেষবারের মতো ঢাকায় আসেন। আসার পর কবি আর বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকাতেই ছিলেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী এই ঢাকাতেই মসজিদের পাশে তার কবর হয়েছে।

বৈচিত্র্যময় জীবন

বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা নজরুল ইসলাম যেন কক্ষচ্যুত ধূমকেতু। জীবনজুড়ে ছিল তার বৈচিত্র্যময় কাজ। ছিলেন মুয়াযযিন, হয়েছেন শিক্ষক, সে সব ছেড়ে হলেন লেটোদলের সদস্য, এরপর রুটির দোকানে কাজ নেওয়া, বাসাবাড়িতে কাজ করা, সেনাবাহিনীতে যোগদান, সাংবাদিকতা, গীতিকার, সুরকার, গায়ক- কোথায় তার পদচারণা নেই? দুরন্ত, তেজস্বী, সৃষ্টিমাতাল এই শিল্পী ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে, বিশ্বটাকে তিনি দেখতে চাইতেন আপন হাতের মুঠোয় পুরে। কবির সব চঞ্চলতা স্থির হয়েছে ঢাকায় এসে, জীবনাবসানের পর শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে। জন্ম ভারতের বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে, যার কর্মব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গে, এমন মানুষটির শেষ আশ্রয় কীভাবে ঢাকা হলো? নজরুলের স্বভাব, পারিবারিক ঐতিহ্য, বাংলাদেশ জন্মের দর্শন ও তার সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যের সম্পর্ক, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি নজরুলের মমতা এবং বাংলাদেশ তথা ঢাকায় নজরুলের আগমনের ইতিহাস জানা থাকলে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।

বিজ্ঞাপন

ছোটবেলা

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন মাজারের খেদমতগার ও স্থানীয় মসজিদের মুয়াযযিন। নজরুল ছোটবেলায় স্থানীয় মক্তবেই পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু মাত্র নয় বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে তিনি পড়েন অকুল পাথারে। নজরুল ছিলেন তার পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান। একে দ্বিতীয় পক্ষীয় তার ওপর আবার বিশাল পরিবার হওয়ায় নজরুলের দুঃখের সীমা ছিল না। বাবা মরা ছেলেটিকে গ্রামের সবাই দুখু মিয়া বলেই ডাকত। দারিদ্র্যের কারণেই নজরুলকে অল্প বয়সে অর্থ উপার্জনের পথ ধরতে হয়। যে মক্তবে তার হাতেখড়ি সেখানেই মাত্র দশ বছর বয়সে শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। কাজ করেছেন হাজি পালোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন হিসেবেও। গান-বাজনা, সাহিত্যের সঙ্গে তার পারিবারিকভাবেই যোগ ছিল। চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন লেটো দলের নামকরা ওস্তাদ এবং আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষার পণ্ডিত। ভালোবাসার কাঙাল নজরুল সচ্ছলতা, নতুনত্ব এবং স্নেহ-ভালোবাসার অনুসন্ধানে ঘর ছাড়েন, লেটো গানের দলের সদস্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন বিভিন্ন অঞ্চলে। নজরুলের ভবঘুরে জীবনের শুরু এই লেটো গানের দলে যা বিদ্যমান ছিল সারা জীবন ধরে। জীবিকার তাগিদে, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার টানে, ভক্ত-শুভাকাঙ্খীদের আহ্বানে, রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে, মানবতার ডাকে দেশের একপ্রান্ত থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন আরেক প্রান্তে। এর ফলে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব, প্রীতি এবং ভালোবাসার বন্ধন। ঢাকার সঙ্গে নজরুলের এমন বন্ধন যেন কিছুটা বেশিই। ঢাকা নজরুলকে শৈশবে দিয়েছে আশ্রয়, যৌবনে বন্ধুত্ব, কবিত্বের স্বীকৃতি, প্রেমের পুষ্পমাল্য, কর্মের স্বাধীনতা, প্রেয়সী-জীবনসঙ্গিনী, বার্ধক্যে দিয়েছে আশ্রয়, স্বীকৃতি এবং জীবনের অন্তে অন্তিমশয্যা। ঢাকা নজরুলকে সম্মানিত করে নিজে যেমন সম্মানিত হয়েছে, তেমনি কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগও পেয়েছে।

বাংলাদেশে প্রথম

বিজ্ঞাপন

কৈশোরে নজরুল লেটো গানের দলে ইস্তফা দিয়ে জীবিকার তাগিদে আসানসোলের রুটির দোকানে কাজ নিয়েছেন। ঘটনাক্রমে নজরুলের শিক্ষা, ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পান কাজী রফিজউল্লাহ নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি নজরুলের প্রতিভার বিকাশ এবং পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার জন্য তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পরেই কাজী রফিজল্লাহ ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় বদলি হন। নজরুলও এই পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গে আসেন এবং পার্শ্ববর্তী স্কুলে ভর্তি হন। তিনি অবশ্য স্বভাবসুলভ চঞ্চলতার কারণে সেখানেও বেশিদিন থাকেননি, ফিরে যান নিজগ্রাম চুরুলিয়ায়। এ সময় তিনি ঢাকা আসেননি বটে কিন্তু পূর্ববঙ্গের সে দিনগুলোকেও তিনি ভোলেননি। এরপর প্রাপ্তবয়সে তিনি যখনই পূর্ববঙ্গ বা ঢাকায় এসেছেন ময়মনসিংহ জীবনের কথা স্মরণ করেছেন বক্তৃতায়, আলোচনায়।

ঢাকায় পদার্পণ

নজরুল ইসলামের ঢাকায় উপস্থিতির কথা জানা যায় প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা থেকে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নজরুল প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯২৫ সালের ৪ জুলাই। ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে দেশীয় দলের বিজয়ের আনন্দে কবি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন জয় উদযাপন করতে। দ্বিতীয়বার কবি ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের জুন মাসের শেষের দিকে। নজরুলের এ ঢাকা আগমনের সঙ্গে মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ঢাকায় ১৯২৬ সালের মুসলিম সমাজের কুসংস্কার দূর ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের উদ্দেশ্যে জানুয়ারি মাসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটি পূর্ববাংলায় মুসলিম সমাজে প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ ও মুক্ত চিন্তার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা কবিকে আকৃষ্ট করে এবং এই সংগঠনের আমন্ত্রণে কবি ঢাকায় দ্বিতীয়বার আসেন। এ সময় কবি বর্তমান পুরান ঢাকার মোহিনীমোহন দাশের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই বাড়িতে কবির সঙ্গে প্রথমবারের মতো কবি আবদুল কাদের, মোহাম্মদ কায়েস ও আবদুল মজিদের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২৭ জুন নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আয়োজিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। এই বৈঠকে কবি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেওয়ার পর তার কয়েকটি জাগরণী গান গেয়ে শোনান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আমরা ছাত্রদল’, ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’, ‘কৃষাণের গান’ প্রভৃতি। এ বৈঠকসূত্রেই কবির সঙ্গে পরিচয় হয় কাজী আবদুল ওদুদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে। এ সময় তিনি এক বা দু’দিন ঢাকায় ছিলেন। সে সময় কবিকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিয়েছিলেন কবি আবদুল কাদের, মোহাম্মদ কায়েস ও আবদুল মজিদ।

এরপরে কবি বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের আমন্ত্রণে। কবি তৃতীয়বার ঢাকায় আসেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে। এ সময় তার আবাসনের ব্যবস্থা হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সঙ্গে বর্ধমান হাউজে। বর্ধমান হাউজ তখন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউজ টিউটর হিসেবে ওই গৃহের বাসিন্দা ছিলেন। কবির এ ভ্রমণ সম্পর্কে তার বন্ধু লেখক, প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে বিস্তারিত জানা যায়। ১৯২৭ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি এই সম্মেলনের বিশিষ্ট সম্মানীয় অতিথি ছিলেন। উদ্বোধনী সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের তরুণ সদস্যদের উদ্দেশ্যে উৎসাহমূলক বক্তব্য দেন কবি। এখানে আসার পথে ‘খোশ আমদেদ’ (স্বাগতম) নামে উদ্বোধনী সংগীতটি রচনা করেন। এ ভ্রমণে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার কবিকে জগন্নাথ হলে আমন্ত্রণ জানান। কবি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং জগন্নাথ হলের সভায় তার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। এর একটি হলো, ‘কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে?’

বিজ্ঞাপন

নজরুল পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮ সালেও মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনেও ঢাকায় আসেন। এ সম্মেলনে তিনি তার বিখ্যাত মার্চ সংগীতটি গেয়েছিলেন। এই সংগীতটি এই ভ্রমণেই সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করার সময় লিখেছিলেন। এ সময় তার পরিচয় হয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত এবং গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে।

একই বছরের জুন মাসে পুনরায় নজরুল ঢাকায় এলে রানু সোম ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে তার পরিচয় ও সংগীতের সম্পর্ক তৈরি হয়। কাজী মোতাহার হোসেন লিখেন, “সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদানের পর কবি বুড়িগঙ্গাতীরের জমিদার রূপলাল বাবুর বিশাল অট্টালিকা রূপলাল হাউজে যান এবং সেখানে গান গাইলেন, ‘বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে কে উদাসিনী’, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’। ঢাকায় এসে তিনি বর্ধমান হাউজের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) নিচের তলায় আমার সঙ্গে থাকতেন। এ সময় বেশ কয়েকটি নিমন্ত্রণে কবির সঙ্গে আমি ছিলাম। নজরুল ঢাকায় যতদিন বর্ধমান হাউজে ছিলেন তিনি নিয়মিত প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে মনোরম সংগীত চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন।”

ঢাকায় নজরুলের এসব আড্ডার আনন্দময় একটি চিত্র পাওয়া যায় মুর্তজা বশীরের লেখায়। মুর্তজা বশীর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সন্তান জেনে লেখক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় শহীদুল্লাহ এবং নজরুলের জীবনের একটি ঘটনা বলেন। গান-বাজনার একটি আসরে প্রবেশের সময় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় দেখেন যে কমরেড মুজাফফর আহমদ এক পাশে নিশ্চুপ বসে আছেন। মুখে পান চিবুতে চিবুতে কাজী নজরুল ইসলাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছেন আর টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে নাচছেন শহীদুল্লাহ। শুধু তাই নয়, এ সময় কবি অনুরাগীদের বাড়িতে গিয়ে গানও শেখাতেন। এ জন্য কবিকে লাঞ্ছনার শিকারও হতে হয়েছে। বনগ্রাম লেনে রানু সোমকে গান শেখাতে গেলে সেখানকার কিছু যুবক কবির ওপর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষিত কবির সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। তিনি তাদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। যুবকরা পালিয়ে যায়। এই রানু সোম পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রতিভা বসু নামে পরিচিত হন।

ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং তখন পর্যন্ত একমাত্র মুসলিম ছাত্রী (গণিত) বেগম ফজিলাতুন্নেসা মোতাহার হোসেনের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। নজরুল বিষয়টি জানলে তার সঙ্গে দেখা করতে চান। কবি হাত দেখে ভাগ্যগণনা করতে পারেন এমন তথ্য ফজিলাতুন্নেসাকে জানালে তিনিও কবির সঙ্গে দেখা করতে চান। সাক্ষাতের পর প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নজরুল ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবনরেখা, হৃদয় রেখাসহ শুক্র, শনি, রবি, বুধ মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থান নিরীক্ষা করলেন। ঘণ্টাখানেক পর মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমান হাউজে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন কবি শয্যায় নেই। সকালে নাস্তার সময় ফিরে এসে ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়ার কথা জানালেন। পরবর্তী সময়ে কবি কলকাতায় ফিরে ফজিলাতুন্নেসাকে বেশ কয়েকটি চিঠি লেখেন, তার প্রকাশিত বইয়ের একসেট উপহার পাঠান। নজরুল তার পরবর্তী বই সঞ্চিতা উৎসর্গ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতে নজরুল দুঃখ পেলেও আর এগোননি। কিন্তু বিরহ কাতরতায় বন্ধু মোতাহারকে চিঠি লিখতে বাধ্য হন। কবি বর্ধমান হাউজে থাকাকালীন রমনায় বসে থাকতে পছন্দ করতেন। এখানে তিনি গানের সুরের কথা ভাবতেন। জায়গাটি তার এত ভালো লেগে যায় যে সাপের ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি এখানে বসে লেকের পানির ওপর আলোছায়ার খেলা দেখতে আসতেন। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত বর্ধমান হাউজটি বর্তমানে বাংলা একাডেমির অঙ্গীভূত এবং একাডেমি কর্তৃপক্ষ একে লেখক জাদুঘর হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখানে নজরুলের বিভিন্ন জিনিস বিশেষ করে লাঙল, ধূমকেতু ইত্যাদি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রদর্শিত রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নিমন্ত্রণ ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব

কবি ১৯৩৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আবার ঢাকায় এসেছিলেন। কবি তখন পুরোদস্তুর গীতিকার। কবির এ সময়ের সফরসঙ্গী ছিলেন ধীরেন দাশ, নলিনীকান্ত সরকার এবং আব্বাস উদ্দীন আহমদের মতো বরেণ্য শিল্পী। নজরুল ইসলাম ছিলেন খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। ১৯৩৫ সালে কলকাতার খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করতে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় তিনি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসেন। গোয়ালন্দ নেমে স্টিমারে করে চলে আসেন ঢাকায়। এ যাত্রায় তিনি কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় ওঠেন। এ সময় বুড়িগঙ্গার তীরে রূপলাল হাউজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে রূপলাল হাউজের ভগ্নদশা। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বুদ্ধদেব বসু কবির সম্মানে জগন্নাথ হলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কবি ঢাকায় পা রাখেন ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে। বনগ্রাম লেনের সুনীল রায়ের বাড়ি ছিল সেবারের আস্তানা।

১৯৪০ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য কবি সে বছর ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তিনি সংবর্ধিত হন। বলা যায়, সুস্থ অবস্থায় এটিই ছিল ঢাকায় কবির শেষ আগমন। এরপর কবি ঢাকায় আসেন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে।

১৯৭১ সালে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সেদিন বিমানবন্দরে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কিন্তু কবি জনতার অভিবাদন গ্রহণ করতে পারেননি। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি ভবনে আনা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শিয়রে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এ অবস্থায় কবি বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে মুখ নাড়ান কিন্তু কোনও শব্দ উচ্চারিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু চিকিৎসকের একটি বোর্ড গঠন করে কবির চিকিৎসার নির্দেশ দেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এবং ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পায়। এ চিকিৎসায় বেশ ভালো কাজ হয়। কবি ধীরে ধীরে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি কবি ভবনের সামনে বাগানে নিজে নিজে বেড়াতেও পারতেন তখনও তিনি ছিলেন নির্বাক। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৩ জুলাই কবি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি ছিলেন ১১৭ নম্বর কেবিনে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মারা যান।

মৃত্যুশয্যায় কবির পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। নজরুলের মরদেহ প্রথমে আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনের মাঠে। পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে নজরুলকে সমাহিত করা হয়। এভাবেই ঢাকার সঙ্গে মিশে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন