বিজ্ঞাপন

চিংড়ি চাষে চোরাই ‘নপ্লি’ বন্ধে উদ্যোগ চান হ্যাচারি মালিকরা

May 26, 2023 | 11:08 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশে চিংড়ি চাষের প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা ‘নপ্লি’। দেশের সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত থেকে চোরাই পথে ‘নপ্লি’ আসার প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। আর এই ভাইরাসযুক্ত নপ্লি আসা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ চান রোগমুক্ত চিংড়ির পোনা (এসপিএফ) উৎপাদনকারী হ্যাচারির উদ্যোক্তারা। কার্যকর উদ্যোগ চেয়ে এরইমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে মৎস্য অধিদফতরে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চিংড়ি চাষে চোরাই নপ্লি (ছোট পোনা) বন্ধে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে নার্সিং পয়েন্টগুলোতে আরও বেশি হারে অভিযান পরিচালিত হবে।

পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারির উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রচলিত মৎস্য ও হ্যাচারি আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হলে দেশে চোরাই নপ্লি আসা যেমন বন্ধ হবে, তেমনি দেশে বাড়বে চিংড়ির উৎপাদন। আর রোগমুক্ত পোনার প্রসারেই ঘটবে চিংড়ি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

উদ্যোক্তারা জানান, চিংড়ি চাষের অন্যতম প্রধান উপকরণ গুণগতমানসম্পন্ন পোস্ট লার্ভা বা চিংড়ি পোনার ব্যবহার। চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে নির্দিষ্ট রোগবালাইমুক্ত পোনা বা স্পেসিফিক প্যাথোজেন ফ্রি (এসপিএফ) পোনা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এসপিএফ পোনা চিংড়ির হোয়াইট স্পট, হোয়াইট-টেইলসহ ১২টি রোগ বালাই মুক্ত। এই পোনার বেঁচে থাকার হারও নন-এসপিএফ’র তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সরকার এই পোনার ব্যবহারও উৎসাহিত করছে। সাধারণত দেশের সমুদ্র থেকে মা চিংড়ি ধরে পোনা উৎপাদন করা হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্য কোনো দেশে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় না।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা জানান, মা চিংড়ি ডিম ছাড়ার পর সেটি যখন ফুটে তাই ‘নপ্লি’। ২২ থেকে ২৪ দিন পর ওই নপ্লি থেকেই চিংড়ির পোনা হয়। আর ভারত থেকে চোরাইপথে আসা রোগযুক্ত ওই নপ্লি ব্যবহার করে বাংলাদেশে চিংড়ি চাষে রোগের বিস্তার ঘটছে। বিপরীতে ভারতেও সমুদ্র থেকে মা চিংড়ি ধরে নপ্লি সংগ্রহ করে চিংড়ি চাষ করা হয় না। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারতের সমুদ্র সীমা থেকে মা চিংড়ি আহরণ করে তা থেকে নপ্লি সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর খুলনা ও সাতক্ষীরার নার্সিং পয়েন্টগুলোতে সেই নপ্লি ব্যবহার করে চিংড়ির পোনা উৎপাদন হচ্ছে।

আরও পড়ুন: লক্ষ্য রোগমুক্ত চিংড়ি পোনা, বাধা চোরাই ‘নপ্লি’

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি সারাবাংলায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই চোরাই পথে নপ্লি আসার বিষয়টি সামনে আসে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর, চোরাই নপ্লি প্রতিরোধ ও রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার প্রসারে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে দেশের প্রথম এসপিএফ পোনা উৎপাদনকারী এমকেএ  হ্যাচারি।

মৎস্য অধিফতরর মহাপরিচালককে পাঠানো ওই চিঠিতে চোরাই নপ্লি আসা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে এমকেএ হ্যাচারির মালিক মঈন উদ্দিন আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশের সমুদ্র থেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।

অন্যবারের মতো এবারও এই নিষিদ্ধকালীন সময়ে চোরাইপথে অবৈধভাবে রোগযুক্ত নপ্লি আসছে। আর ওই রোগযুক্ত নপ্লি ব্যবহার করে বাংলাদেশে চিংড়ি চাষে রোগের বিস্তার ঘটছে। ভারতেও কিন্তু সমুদ্র থেকে মা চিংড়ি ধরা নিষিদ্ধ। অথচ আসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধকালীন সময়ে রোগযুক্ত নপ্লি পাঠায় এবং পাঠাচ্ছে। যেহেতু সরকার চিংড়ি চাষে রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার প্রসার চায় এবং সহায়তা করছে, তাই যে কোন মূল্যে ভারত থেকে চোরাইপথে নপ্লি আসা বন্ধ করা উচিত।

জানতে চাইলে চিংড়ি হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এসএইচএবি)’র সভাপতি আশেক উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ দ্বিতীয় চিংড়ি রফতানিকারক দেশ ছিলো। অথচ এখন চিংড়ি রফতানি অনেক কমে গেছে।

বিজ্ঞাপন

দেশে বিভিন্নভাবে চিংড়ির পোনা উৎপাদন হয়। প্রচলতি ও রোগমুক্ত দুই ধরণের পোনাই উৎপাদিত হচ্ছে। সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে খুলনা ও সাতক্ষীরায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে চোরাই নপ্লি আসছে। এ কারণে দেশে চিংড়ির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশে রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার প্রসার ঘটলে চিংড়ি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। তাই চোরাই নপ্লি বন্ধে ও রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার প্রসারে সরকারের আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ।

এ বিষয়ে শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এসএইচএবি)’র মহাসচিব মো. নজীবুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, খুলনা-সাতক্ষীরায় নার্সিং পয়েন্ট আছে, তাদের হ্যাচিং নেই। তারা সাধারণত নপ্লি নেয় কক্সবাজার থেকে। তবে দেশে মাছ ধরার নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত থেকে চোরাইপথে নপ্লি নিয়ে আসে।

আমরা বিষয়টি মৎস্য অধিদফতরকে জানিয়ে আসছি। কিন্তু দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করছি না। যে নপ্লিগুলো আসছে, তার সোর্স ঠিক নেই, কোন হ্যাচারি থেকে আসছে কারো জানা নেই। এতে চিংড়ি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত থেকে যে নপ্লিগুলো আসছে তাতে যদি কোন ভাইরাস বা রোগবালাই থাকে, এবং ওই পোনা দিয়ে চিংড়ি চাষ হলে তাতে মড়ক দেখা দেবে এবং তা অন্য ঘেরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।

অথচ নির্বিঘ্নে ভারত থেকে চোরাই নপ্লি আসছে, যা দেশের চিংড়ি চাষে বিরাট ক্ষতি করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক সারাবাংলাকে বলেন, চোরাই নপ্লি আসা বন্ধে আমরা দ্রুত উদ্যোগ নেব। আমরা রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার প্রসারে নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষে রোগমুক্ত চিংড়ির পোনা (এফপিএফ) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে।

মৎস্য অধিদফতরের উপ পরিচালক (চিংড়ি) মো. আয়নাল হক সারাবাংলাকে এ বিষয়ে বলেন, চোরাই পথে নপ্লি আসলে তা প্রতিরোধে আইন প্রয়োগ করা হবে। মৎস্য অধিফতরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালিত হয়। দেশে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে আমাদের অভিযান আরও বেশি অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের খুলনা বিভাগের উপ পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা আইন শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে অবৈধ পথে আসা চোরাই নপ্লির বিষয়টি তুলেছি। জেলা প্রশাসক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। তারা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখবে। নার্সিং পয়েন্টগুলোতে আমাদের অভিযান চলবে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, এখনো নার্সিং পয়েন্টগুলোতে পুরোনো নপ্লি রয়েছে। দুই এক দিনের মধ্যে পুরোনো নপ্লি শেষ হলে আমরা নার্সিং পয়েন্টগুলোর সোর্স দেখবো, কোন হ্যাচারি থেকে আনা হয়েছে, ওই নপ্লির সোর্স কি সেই কাগজপত্র দেখা শুরু করবো। চোরাই নপ্লি প্রতিরোধে আমরা আমাদের ব্যবস্থা নেব।

এদিকে, দেশে চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে রোগমুক্ত চিংড়ির পোনার (এসপিএফ) প্রসারে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি হ্যাচারিতে রোগমুক্ত চিংড়ির পোনা উৎপাদন হলেও শিগগির এ তালিকায় আরও নাম যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

দেশে নির্দিষ্ট রোগবালাইমুক্ত চিংড়ির পোনা বা স্পেসিফিক প্যাথোজেন ফ্রি (এসপিএফ) উৎপাদনে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ এর অধীনে এসপিএফ হ্যাচারি ও নার্সারি তৈরির কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পের অধীনে পাঁচটি সাধারণ হ্যাচারিকে এসপিএফ হ্যাচারিতে উন্নীত করা হচ্ছে। আটটি সাধারণ নার্সারিকে এসপিএফ নার্সারিতে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় চলমান ওই প্রকল্পের অধীনে এসব হ্যাচারি ও নার্সারিকে সহয়তা দেওয়া হচ্ছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এনইউ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন